এম কামরুজ্জামান,শ্যামনগর সাতক্ষীরা প্রতিনিধিঃ অদম্য তামান্নার বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসা পৌঁছে দিতে ফুল মিষ্টি ও নগদ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে হাজির হলেন সাতক্ষীরা-৪ আসনের মানবিক জাতীয় সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার। তিনি জীবন সংগ্রামী মেধাবী তামান্নাকে মিষ্টিমুখ করান এবং পরিবারের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানার জন্য দোয়া চান।
জন্মগতভাবে দু’ হাত আর এক পা না থাকায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য যাকে ভর্তি করাতে পিতা রওশন আলীকে স্কুলে স্কুলে ঘুরতে হয়েছে; সেই তামান্না আক্তার নূরা এক পায়ে ভর করে চড়েছে সফলতার এভারেস্টে। এক পায়ে লিখে এইচএসসি পরীক্ষাসহ বিগত সকল পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তামান্না।
সোমবার ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩ টায় ৩৩ মিনিটে তামান্নার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ভিডিও কল দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইসময় তামান্না কলটি রিসিভ করতে পারেনি। এরপর ৩টা ৩৬ মিনিটে তামান্নার একই নম্বরে এসএমএস লেখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি লিখেছিলেন,‘তুমি খুব সুন্দর দেখতে। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার পড়াশোনা করতে যা দরকার আমি করবো। তোমার পরিবারে কে কে আছেন?’ তামান্না ওই এসএমএসের রিপ্লে না করায় তিন মিনিট পর ৩টা ৩৯ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী আরেকটি এসএমএস দেন। তখন তিনি লেখেন, ‘তুমি নূর, মানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে এক ঐশ্বরিক জ্যোতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।’ তামান্না অফলাইনে থাকায় পরের এসএমএসটিও দেখতে পায়নি। সর্বশেষ, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তামান্নার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানা। তখন তামান্না ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠেন,‘আমি লন্ডন থেকে শেখ রেহানা বলছি। আমি কি তামান্না নূরার সঙ্গে কথা বলছি।’ তখন আবেগে কেঁদে ফেলে তামান্না। কান্না থামাতে বলে শেখ রেহানা বলেন কাঁদে না। টানা ভালো রেজাল্ট করায় তোমাকে অভিনন্দন। তোমার সংগ্রামের কথা শুনেছি। তুমি খুব সাহসী। তুমি এগিয়ে যাও। আমরা দু’ বোন বেঁচে থাকা পর্যন্ত তোমার সহযোগিতা করে যাবো। যারা সাহস রেখে চলে তারা কখনো হেরে যায় না।’ ওইসময় শেখ রেহানা জানান, তার বোন শেখ হাসিনার ফোন কলের বিষয়টি।
এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার ১৭ ফেব্রুয়ারি অদম্য তামান্নার বাড়িতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে হাজির হন জগলুল হায়দার এমপি।তিনি তামান্নার হাতে নগদ ৫০ হাজার টাকা উপহার দেন।
তামান্না আক্তার নূরা যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুর গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পী দম্পতির সন্তান। বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছার ছোট পোদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার গণিতের শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাই বোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রোশনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে।
তামান্নার আজকের এই পর্যায়ে উঠে আসার গল্পটি মসৃণ নয়। এ জন্য তাকে ডিঙোতে হয়েছে কষ্টের এক একটি সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি যেমন তামান্নার; ঠিক তেমনটাই তার বাবা মায়েরও। সেসব কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তামান্নার পিতা রওশন আলীর চোখ। রওশন আলীর বর্তমান বাড়ি বাঁকড়ায় হলেও তিনি ছিলেন ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রামে। রওশন আলীর মা রিজিয়া বেগম মারা যাওয়া পর তার পিতা হযরত আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাসিমা বেগমকে। সেই সময় থেকে প্রতিকূলতার সাথে লড়তে হয়েছে রওশন আলীকে। তিনিও ছিলেন অদম্য মেধাবী। স্কুল জীবনে বরাবরই প্রথম হতেন। বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি, এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাসের পর বাঁকড়ার খাদিজা পারভীন শিল্পীর সাথে বিয়ে হয় রওশন আলীর। ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সংসারে আসে তামান্না নূরা। জন্মগতভাবে দু’টি হাত ও একটি পা না থাকায় নানা গঞ্জনা সইতে হয়েছে এই দম্পত্তিকে। শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেয়ায় পরিবার থেকে রওশন আলীকে চাপ দেয়া হয় স্ত্রীকে তালাকের জন্য। আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল ইনজেকশন পুশ করে মেরে ফেলার জন্য। সেসব কথায় কর্ণপাত না করে জন্মস্থান পানিসারা থেকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাঁকড়ায় চলে আসেন রওশন আলী। তামান্না একটু বড় হলে রওশন আলীর বন্ধু মহল পরামর্শ দিয়েছিল ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে গিয়ে কোথাও শিশু তামান্নাকে বসিয়ে রেখে বাড়িতে চলে আসার। সেসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রওশন আলীর কণ্ঠরোধ হচ্ছিল কান্নায়। চোখের জলের ধারা চেষ্টা করেও তিনি রুদ্ধ করতে পারেননি। সে সময় তিনি পণ করেন যে করেই হোক তামান্নাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন। নন এমপিওভুক্ত ছোট পোদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন প্রায় বিনা বেতনে। টিউশনির টাকায় ভর করে চলতে থাকে তামান্নার পড়ালেখা। তবে, সেখানেও তাদেরকে সইতে হয়েছে নানা অসহযোগিতা আর তিক্ত বাক্যবান। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরেও তাকে ভর্তি করাতে পারেননি তিনি। পরে ব্র্যাকের প্রাক প্রাথমিকে ভর্তি করান তামান্নাকে। সেখান থেকেও বিতাড়িত হয় তামান্না। পরে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি করা হয় তামান্নাকে। সেখানে সবাই যখন চেয়ার বেঞ্চে বসেছে তামান্নাকে বসতে হয়েছে বাবা মায়ের জায়নামাজ পেতে।২০১৩ সালে পিইসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে প্রথমে তাক লাগিয়ে দেয় তামান্না। তারপর ২০১৬ সালে বাঁকড়া জে কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসিতেও জিপিএ-৫ পায়। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালে এসএসসিতেও পায় জিপিএ-৫। তখন থেকে আলোচনায় আসে তামান্না নূরা। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে তামান্না।
এখন তামান্নার চোখে শুধুই বড় হওয়ার স্বপ্ন। পড়তে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হতে চায় বিসিএস ক্যাডার অথবা যুক্ত হতে চায় গবেষণার সাথে। প্রধানমন্ত্রীর সহায়তার আশ্বাসে সে স্বপ্ন ডানা মিলছে দূর দিগন্তে
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।