নিজস্ব প্রতিবেদকঃ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। এ সময়ের মধ্যেই সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন দলটির শীর্ষ দুই নেতা- চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর এই ১৫ বছরের খরা কাটিয়ে ক্ষমতার সিঁড়ির দিকে এগোতে চায় দলটি। এই লক্ষ্য অর্জনে চলতি নতুন ইংরেজি বছর ২০২৩ সালকেই বেছে নিয়েছে বিএনপি। সেক্ষেত্রে চলমান আন্দোলনে সরকারবিরোধী সব দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর একবছর বাকি। এ সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে বিএনপিকে। সেক্ষেত্রে চলতি বছরটি বিএনপির জন্য বহুমুখী চ্যালেঞ্জের।
বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তুলে সরকার পতনের মধ্যদিয়ে এতদিন ধরে নানা প্রতিকূলতার ডিঙিয়ে টেনে নিয়ে আসা আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায় বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে এই সফলতার দিকে আন্দোলনকে নিয়ে যেতে না পারলে মাশুল দিতে হবে, এ কথাও জানা আছে বিএনপি নেতাকর্মীদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ২০২২ পার করেছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনমুখী বিএনপির জন্য ২০২৩ সাল আরও কঠিন। আরও কৌশলী না হলে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা বিএনপির জন্য আরও চ্যালেঞ্জের হবে।
বিএনপির শীর্ষ সারির একাধিক নেতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, গত বছর ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশে ঘোষণা করা ১০ দফা বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করা, সরকার পরিবর্তনের দাবিতে চলমান আন্দোলন-কর্মসূচিতে আরও জনমত তৈরি ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, নেতাকর্মীদের মুক্তি, দলের নিষ্ক্রিয়দের সক্রিয় করাকে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে দলটি। আর এই চ্যালেঞ্জ তারা উত্তরণের জন চলতি বছরকেই বেছে নিয়েছে।
এছাড়া, ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার পক্ষে জনমত তৈরিতে আবারও দেশের জেলা সফর শুরু করেছেন দলটির শীর্ষ সারির নেতারা। চলমান আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে গতকালও বিভিন্ন জেলা সফর করেছেন বিএনপি নেতারা। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয়সহ নিজ দুর্গ গোছাতে চায় দলটি। অহিংস আন্দোলনের ধারা ধরে রেখে বছরের মধ্যভাগে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে দলটি এগোতে চায় বলে আভাস পাওয়া গেছে।
আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে দলটির নেতারা খোলাখুলি বলতে না চাইলেও ১০ দফা আদায়কেই প্রধান লক্ষ্য ধরে কাজ করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দলটির সিনিয়র নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনও এমন কথাই জানালেন। গতকাল রাতে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পাবলিকলি ঘোষণা করা ১০ দফা দাবি আদায়ই চলতি বছর বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য। এ লক্ষ্যেই চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আজও (মঙ্গলবার) নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করেছেন। ১০ দফার বিষয়ে জনগণের সাড়া আছে, আস্থা আছে।’
রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার বিষয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘ওই ২৭ দফা বাস্তবায়ন করবে তারাই যারা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে সরকারবিরোধী জোট ও দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য আরও মজবুত করবে বিএনপি। নিজেদের মধ্যে যাতে দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ছোট ছোট দলের ভেতরে বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণে সমমনা অনেক ছোট দলের আবদারকে বিএনপি গুরুত্ব দেবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীনরা চলমান আন্দোলনে বিএনপির বিরুদ্ধে মামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে দলের সক্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তাই নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও নেতৃত্ব শূন্যতায় যাতে আন্দোলনের গতি থমকে না যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড। তৈরি করা হচ্ছে কয়েক স্তরের নেতৃত্ব।
অন্যদিকে, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে ১০ দফা বাস্তবায়নে নতুন কৌশলও গ্রহণ করতে পারে বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা না হলে নির্বাচনের ছয় মাস আগে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে দলটি। অবশ্য আসছে রোজার আগেই বিএনপি সরকার পতন আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছে। এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও ১২ দলীয় জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা।
সূত্র জানায়, অবিলম্বে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১০ দফা ঘোষণা করেছে বিএনপি। এসব দাবি আদায়ে সমমনা দল ও জোটগুলোকে নিয়ে আগামী কয়েক মাস শান্তিপূর্ণ যুগপৎ কর্মসূচিতেই থাকবে দলটি। যুগপতের দ্বিতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১১ জানুয়ারি সব বিভাগীয় শহরে ৪ ঘণ্টার গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।
এভাবে মানববন্ধন, লংমার্চ, অনশন ও আবারও সমাবেশের কর্মসূচি আসতে পারে। অবস্থা বুঝে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সরকার আবারও একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলে সমমনা দল ও জোটগুলোকে নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে চায় বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, মাঠের আন্দোলনে প্রধান শক্তি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। বাকি দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি ততটা না থাকলেও কৌশলের কারণে তাদের পাশে রাখা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি বিদেশিদের কাছে একটা বার্তা যাবে যে, সরকারবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। তাই যে কোনো মূল্যে যুগপৎ আন্দোলনে সব দলকে নিয়েই মাঠে থাকতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে ৩৩টি রাজনৈতিক দল জোট ও পৃথকভাবে অংশ নিয়েছে।
কী আছে বিএনপির ১০ দফায়
১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, ওই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা।
৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করা।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা।
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা।
৮. বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন/দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা।
১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। এদিকে বিএনপির ঘোষণা করা এই ১০ দফা দাবি আদায়ের সম্ভাবনার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, ‘সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে সরকারপতন আন্দোলন চূড়ান্তভাবে গড়ে তুলে ১০ দফা দাবি আদায় সম্ভব।’
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।