নিজিস্ব প্রতিনিধিঃ ডলার সংকট আর আমদানিতে কড়াকড়ির অজুহাতে দেশের মসলার বাজার অস্থির করে তুলছে আমদানিকারকরা। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে। ফলে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মসলার বাজার। আদা, রসুন, জিরা, হলুদ, মরিচ, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জয়ত্রিসহ সব মসলার চাহিদা বাড়ছে। আর এই চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়ানোর অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তারা। আমদানি করা মসলা গুদামে আটকে রাখারও অভিযোগ রয়েছে প্রায় শতাধিক আমদানিকারকের বিরুদ্ধে।
মসলা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, জিরা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো মসলা পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম আগের চেয়ে কমেছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, আমদানিনির্ভর মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন কিছু ব্যবসায়ী। প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ীর ইঙ্গিতেই মসলার দাম বাড়ে-কমে।
মসলা বিক্রেতারা বলেন, মসলার বাজার ঈদের আগে একটু বাড়তি থাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মনিটরিং জোরদার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর ক্রেতারা মনে করেন, গত কয়েক মাসে যেভাবে মসলার দাম বেড়েছে, তা সীমার বাইরে।
বাজার দর ও পাইকারি মসলা ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত তিন থেকে ছয় মাসে মসলা পণ্যের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ, প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে জিরার দাম।
মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের প্রধানতম গরম মসলার একটি জিরা। কিন্তু জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ ও এলাচের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি আসন্ন কোরবানির ঈদে ভোক্তাদের ওপর চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ থেকে ৮৫০ টাকায়। বিভিন্ন হাত ঘুরে এ জিরা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকার বেশি দামে। দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে তিন মাস আগেও ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে জিরা, যা বর্তমান দামের চেয়ে প্রায় ৪৫০ টাকা কম।
একইভাবে কেজিতে ৪০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ ১৫০০ টাকা, ৭০০ টাকা বেড়ে লবঙ্গ ১৫০০ টাকা, ১০০০ টাকা বেড়ে জায়ফল ৩০০০ টাকা, ২০০ টাকা বেড়ে মিষ্টি জিরা ৩১০ টাকা, ১৫০ টাকা বেড়ে গোলমরিচ ৬৭০ টাকা, ১৫০ টাকা বেড়ে জয়ত্রী ৭৫০ টাকা, ৭০ টাকা বেড়ে দারুচিনি ৩২০ টাকা, ৬০ টাকা বেড়ে ধনিয়া ১৮০ টাকা, ৫০ টাকা বেড়ে সরিষা ১০৫ টাকা এবং ২০ টাকা বেড়ে তেজপাতা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।
এ ছাড়া সরবরাহ সংকটে চীনা আদা ও চীনা রসুনের দামও অস্থির। তবে চীনা আদার সরবরাহ না থাকায় সম্প্রতি মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে আসা আদার দাম ২৬০-২৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চীনা রসুনের দামও ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে।
স্বাভাবিক সময়ে ১৫০-২৫০ টাকার মধ্যে শুকনা মরিচ বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ঠেকেছে ৪৫০-৫০০ টাকায়। তবে মসলা পণ্যের মধ্যে স্থির থেকে ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আস্ত শুকনা হলুদ। বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫-৪৫ টাকায়। আর স্থানীয় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকায়। যদিও সরকারের আমদানি অনুমতির ঘোষণার আগ পর্যন্ত পণ্যটির দাম ঠেকেছিল ১০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারকরা জানান, বাংলাদেশের অধিকাংশ মসলা পণ্যই আমদানি হয় বিশ্ববাজার থেকে। এক সময় ব্যবসায়ীরা ৮২ থেকে ৮৪ টাকার ডলার দিয়ে পণ্য আমদানি করতো। এখন ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১২ টাকা। পণ্যের দামের ওপর শুল্ক নির্ধারণ হওয়ায় আমদানি খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যার কারণে মসলা পণ্যের দাম অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। এ ছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় আসন্ন কোরবানির ঈদে দেশে মসলার দাম চড়া থাকবে বলে শঙ্কা তাদের। দেশে যে পরিমাণ মসলার চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে আমদানি অনেক কম। কোরবানির ঈদে গরম মসলার চাহিদা থাকে কয়েকগুণ বেশি। ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে আমদানিকৃত গরম মসলার দাম বেড়েছে। আমদানি সংকট নিরসন ছাড়া দেশে মসলার বাজার স্থিতিশীলতায় ফেরার কোনো সুযোগ নেই।
জানা গেছে, দেশে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় মসলা। টেকনাফ, বেনাপোলসহ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়েও আসছে মসলা জাতীয় পণ্য। দেশে প্রতি বছর শতকোটি টাকার রসুন আসে। ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার এলাচ আসে প্রতি বছর। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পিয়াজ আসে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার। তবে আমদানি বহাল থাকলে স্থলবন্দর দিয়ে আসে ২০০ কোটি টাকারও বেশি পিয়াজ।
রসুনের শীর্ষ আমদানিকারক ২০টি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি আদা আমদানি করে চার প্রতিষ্ঠান। সবমিলিয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি টাকার আদা এসেছে। বছর শেষে এটি ৭০ থেকে ৮০ কোটিতে পৌঁছবে।
এ বছর এখন পর্যন্ত এলাচ এসেছে প্রায় দেড় হাজার টন। এগুলোর মূল্য পড়েছে ১৭০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি এলাচ আমদানি করেছে ৩টি প্রতিষ্ঠান। সবক’টিই চট্টগ্রামের। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার এলাচ আসে দেশে। মসলার মধ্যে জিরা, দারুচিনি, হলুদ, মরিচ ও জয়ত্রী আমদানির পেছনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয় প্রতি বছর। এসব পণ্যেরও নিয়ন্ত্রক ঘুরেফিরে ৩০ থেকে ৪০ জন।
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।