ডেস্ক রিপোর্টঃ আজ বৃহস্পতিবার সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। দেশের ৫০০ স্পটে এ সিরিজ বোমা হামলায় দু’জন নিহত এবং অন্তত ১০৪ জন আহত হন।
সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার মামলায় সারাদেশে ১৬১টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৬৬০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১০২টি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। মামলায় মোট ৪৫৭ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় জেএমবিপ্রধান শায়খ আবদুর রহমানসহ ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এর মধ্যে আটজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের পরিবার।
এছাড়াও আরও ২৪৭ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয়। আর আদালত থেকে খালাস পান ১১৮ জন আসামি।
এদিকে সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বাকি ৫৯টি মামলাসহ অনেক মামলার বিচার এখনও নিম্ন আদালতে ঝুলে আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় হাইকোর্টে আসা আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের বিষয়ে পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে।
উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, হাইকোর্টে জঙ্গিদের করা বেশ কিছু ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হয়েছে। অনেক আসামির জামিনের আবেদন এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। তবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়া জঙ্গি ও নাশকতাসংক্রান্ত মামলাগুলো রাষ্ট্রপক্ষ সব সময় মনিটর করে থাকে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁশুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ ঘটনায় ঢাকায় পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। এরমধ্যে দুইটি মামলার রায় ঘোষণা করেছে আদালত। আর বাকি তিনটি মামলার স্বাক্ষ্যগ্রহণ এখনও শেষ হয়নি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ১৬১টি মামলার মধ্যে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে আটটি, আরএমপিতে চারটি, কেএমপিতে তিনটি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে সাতটি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে সাতটি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি , রংপুর রেঞ্জে আটটি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ছয়টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে তিনটি মামলা করা হয়।
২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের (২০২৩) ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এসব মামলার মধ্যে ১৪৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়। বাকি ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মামলাগুলোতে ১৩০ জন এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন। বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে মোট ৯৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছিল এক হাজার ১৩১ জনকে। অভিযোগপত্রের আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এক হাজার ২৩ জনকে। আসামিদের মধ্যে ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ১৫ জনের ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। এসব মামলায় খালাস পেয়েছেন ৩৪৯ জন আর জামিনে আছেন ১৩৩ জন।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, সিরিজ বোমা হামলার পর পরই জঙ্গিদের ধরতে সারাদেশে জেমবিবিরোধী অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযান গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম (বাংলা ভাই), আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ সাড়ে ৪০০ জঙ্গিকে। ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় দুই বিচারককে হত্যা মামলায় ২০০৭ সালে ফাঁসি কার্যকর করা হয় জেএমবির শীর্ষ এ নেতাদের।
তবে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পরে সংগঠনটির আমির হন মাওলানা সাঈদুর রহমান। দ্বিতীয় দফা পুনর্গঠিত হতে থাকে জেএমবি। তিনিও বেশি দিন গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকতে পারেননি। ২০১০ সালের ২৫ মে ঢাকা থেকে তাকেও গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, সাঈদুর রহমান গ্রেপ্তারের চার বছর পর ২০১৪ সালে আবারও জোরালোভাবে নিজেদের শক্তি জানান দেয় জেএমবি। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনতাই করে তারা। এ সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি, রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
জেএমবির নাড়ি নক্ষত্র:
১৯৮৮ সালে শায়খ আবদুর রহমান জেএমবি প্রতিষ্ঠা করলেও প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর ১৯৯৮ সালে সংগঠনটি দেশব্যাপী তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তবে দলটির প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু হয় ২০০৩ সালের প্রথমদিকে। পরে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা ও ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারককে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে এ জঙ্গি সংগঠনটি।
এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর জেএমবির শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আবদুর রহমান, অপারেশন কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ শীর্ষ ছয়জনের ফাঁসি ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ কার্যকর হওয়ার পর আত্মগোপনে যায় সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরা। মতাদর্শগত পার্থক্য ও নেতৃত্ব সংকটের কারণে ২০১৫ সালে জেএমবি থেকে একটি বড় অংশ বেরিয়ে গিয়ে নব্য জেএমবি নামে নতুন সংগঠন তৈরি করে। জেএমবি সংগঠনটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পুরাতন জেএমবি ও নব্য জেএমবি। পুরাতন জেএমবি ছোটখাট নাশকতা করে সংগঠনটি সচল রাখতে চাইলেও নব্য জেএমবি চুপচাপ তাদের সাংগঠনিক ও আর্থিক শক্তি বাড়ানোর কাজ করতে থাকে। যার প্রতিফলন ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে।
হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা করে দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করা হয়। এর ঠিক সপ্তাহখানেক পর ৭ জুলাই শোলাকিয়ার ঈদগাহে আরও একটি হামলা চালায় নব্য জেএমবি। এসব হামলার দায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করলেও একে ‘নব্য জেএমবি’ বা জেএমবির বিদ্রোহীর অংশগ্রহণ বলে বলছেন বাংলাদেশি গোয়েন্দারা।
এ দুই জঙ্গি হামলার পর অনেকটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা জঙ্গি আস্তানার সন্ধান করতে থাকে এবং নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের খোঁজে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে পুলিশের কাউন্টার টোরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এরপর রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ধরতে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের তৎপরতার মুখে নব্য জেএমবি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শীর্ষ জঙ্গিদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। অনেকে আবার ধরা পড়েছেন।
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।