ডেস্ক রিপোর্টঃ কাবুল বিমানবন্দরে দেশত্যাগে ইচ্ছুক মানুষের ভিড়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। নিহতদের ৯০ জনই বেসামরিক আফগান নাগরিক ও ১৩ জন মার্কিন সেনা রয়েছেন। এছাড়া নিহতের মধ্যে ২৮ জন তালেবান সদস্যও রয়েছে। কাবুলে গতকাল এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ইসলামিক স্টেট গ্রুপের আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান বা আইএস-কে এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এ গোষ্ঠীটি চরম সালাফী ভাবাপন্ন বলে জানা গেছে। তালেবানের দলত্যাগী ও বহিরাগতদের নিয়ে এ গোষ্ঠীটি গঠিত হয়েছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালানো ওই হামলায় নিহত বেসামরিক আফগানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৯০ জনে। এছাড়া আরো কমপক্ষে ১৩ মার্কিনিসহ হামলায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। ভয়াবহ ওই আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৫০ জনেরও বেশি মানুষের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে ১৮ জন মার্কিন সেনা ও সার্ভিস মেম্বার রয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, কাবুলের হাসপাতালগুলো আহত লোকজনে উপচে পড়ছে। তাদের চিকিৎসা দিতে সারা রাত ধরে কাজ করেছে ডাক্তার ও নার্সরা। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর হাসপাতালের লোকবলও অনেক কমে গেছে। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে তাদের নাগরিকদের বিমানবন্দর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল।
এদিকে বর্বর এই হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হামলার পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। এ হামলায় তালেবানের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা ক্ষমা করবো না। আমরা এই হামলার কথা ভুলেও যাবো না। আমরা হামলাকারীদের অবশ্যই খুঁজে বের করবো এবং জড়িতদেরকে এর মূল্য দিতে হবে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দেন যে, কাবুল দখলের পর তালেবান কারাগারগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ায় হয়তো সেখান থেকেই হামলাকারীরা বেরিয়ে এসেছে। তিনি এ হামলার জন্য আইএস-কে গ্রুপকে অভিযুক্ত করেন। যদিও বাইডেনের আগেই কাবুলের এ জোড়া হামলার জন্য দায় স্বীকার করে নিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি।
এদিকে হামলার পর শুক্রবার কাবুল বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে উদ্ধার করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান পুনরায় শুরু হয়েছে। এজন্য তাদের হাতে খুব বেশি সময়ও নেই। তালেবানের সাথে হওয়া সমঝোতা অনুসারে ৩১ আগস্টের মধ্যে বিদেশি সৈন্যদের সরিয়ে নিতে হবে। বিমানবন্দরে হামলার ঘটনায় রিপাবলিকান পার্টির নেতারা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কঠোর সমালোচনা করছেন।
সন্ত্রাস-বিরোধী একজন বিশেষজ্ঞ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলের একজন বিশেষ দূত ন্যাথান সেলস বলেছেন, আরো হামলা যাতে না হয় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের অনতিবিলম্বে কাবুল বিমানবন্দরের চারপাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো সভ্য দেশ তালেবানের ওপর আস্থা রাখবে সেটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়’। তিনি বলেন, ৩১ আগস্টের সময়সীমার ব্যাপারেও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিন্তা করে দেখা দরকার। ‘প্রত্যেক আমেরিকানকে আফগানিস্তান থেকে না আনা পর্যন্ত সেখানে আমাদের সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে’, -বলেন তিনি।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ব্রিটেনও কাবুল থেকে লোকজনকে উদ্ধারের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ের কাজ শুরু করেছে। তিনি জানান, শুক্রবার এক হাজারের মতো লোককে সরিয়ে আনা হতে পারে। তিনি জানান, বিমানে আরো বেশি জায়গা তৈরি করার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কিছু যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে ফেলা হবে বা সেখানে রেখে আসা হবে। তিনি বলেন, উদ্ধারকাজ শেষ করতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি রয়েছে এবং দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে প্রত্যেককেই হয়তো নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। হোয়াইট হাউজ গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর ৯৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে তাদের উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে কানাডা, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাদের উদ্ধার অভিযান আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে।
কাবুলে হামলায় তালেবানের সম্পৃক্ততা নেই
কাবুল বিমানবন্দরে জোড়া হামলার পরপর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র জানায়, এই হামলার সঙ্গে তালেবানরা জড়িত নয়। কাবুল বিমানবন্দরে জোড়া বিস্ফোরণের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নে জবাব দেন হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব জেন সাকি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ হামলার সঙ্গে তালেবান জড়িত কিনা? এর জবাবে তিনি বলেন, এ মুহ‚র্তে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। এখন পর্যন্ত আমরা যা জানি, তাতে তালেবান এ হামলার সঙ্গে জড়িত নয়। সাকি বলেন, আমি মনে করি জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। এ মুহ‚র্তে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। তালেবান এই হামলার ব্যাপারে জানতো বা এর সঙ্গে জড়িত ছিল না বলেই মনে করি। আর গত কয়েক ঘণ্টায় আমাদের সেই অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব আরো বলেন, স্পষ্টতই, যা ঘটেছে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা সদস্যদের প্রাণহানি একটি ট্র্যাজেডি। এটা ভীতিকর। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে আমার অভিজ্ঞতা হওয়া সবচেয়ে খারাপ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি এটি। কিন্তু, এ মুহ‚র্তে আমাদের অতিরিক্ত কোনও মূল্যায়ন নেই।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সাকি বলেন, এ হামলার পর উদ্ধার অভিযান চালিয়ে নেয়ার জন্য তালেবানদের সঙ্গে ‘সমন্বয় করতে’ হবে মার্কিন বাহিনীকে। তিনি বলেন, দেখুন, তালেবানের ব্যাপারে আমরা কী ভাবছি সেটা নিয়ে অতিরঞ্জিত করতে চাই না। আমরা তাদের বিশ্বাস করি না। তারা আমাদের বন্ধু নয়, আমরা কখনও এটা বলিনি।
কিন্তু এটাও সত্য যে, আফগানিস্তানের বিশাল অঞ্চল এখন তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। আর তালেবানদের সঙ্গে সমন্বয়ের কারণেই আজ পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ৪ হাজারের বেশি মানুষ উদ্ধার করতে পেরেছি। ১ লাখ ৪ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে পেরেছি। আর উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য এই সমন্বয় করাটা জরুরি।
নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেবে না তুরস্ক : এদিকে ন্যাটো প্রত্যাহারের পর তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দর চালাতে সাহায্য করবে না, যদি না তালেবানরা তুরস্কের নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে রাজি হয়। বিমানবন্দরের বাইরে মারাত্মক হামলার পর দুই কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন যে, এ ধরনের মিশনের ঝুঁকি তুলে ধরা হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশী সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহারের সময়সীমার পর তালেবানরা তুরস্ককে বিমানবন্দরটি চালানোর জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা চেয়েছে। তবে তারা বলেছে যে, ৩১ আগস্টের আলটিমেটাম তুর্কি সৈন্যদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ন্যাটো মিশনের অংশ তুরস্ক গত ছয় বছর ধরে বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, আনাদোলু।
বি: দ্র: প্রকাশিত সংবাদে কোন অভিযোগ ও লেখা পাঠাতে আমাদের ই-মেইলে যোগাযোগ করুন।