,

আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের ‘বিশেষ’ তালিকা করছে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
বিভিন্ন মামলার আসামি এবং গ্রেপ্তার হওয়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং এর ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটি ‘বিশেষ’ তালিকা তৈরি করছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে কাজটি করছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার আসামিদের জামিন আইনি প্রক্রিয়ায় ঠেকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে এই তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

পুলিশের প্রক্রিয়াধীন তালিকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও মোবাইল ফোনের নম্বর থাকছে। তাঁদের জামিন প্রতিরোধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বিরোধিতা করার পরিকল্পনাও রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর, জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটর সূত্রে এ তথ্য বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব মামলা করা হয়। এতে আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপি, তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্য।

মামলাগুলোর আসামি মোট ১ লাখ ২৫ হাজারের মতো। তাঁদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের অনেকেই গ্রেপ্তার হলেও কিছুদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন বলে আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ মামলা’ হিসেবে চিহ্নিত ২৫০ মামলার আসামিদের মধ্যে অন্তত ৭২১ জন আসামি জামিন পেয়েছেন। বাইরের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরেও এসব মামলায় জামিনপ্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়ছে। পলাতক আসামিদের নতুন করে গ্রেপ্তারের হারও কম।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জেলার এসপি ও মহানগর কমিশনারদের সতর্কতা বাড়ানোর পাশাপাশি সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পলাতক ও কারাগারে থাকা আসামিদের মামলার নম্বর, অভিযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে সমন্বিত তালিকা করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে সমন্বয় করে আদালতে জামিনের বিরোধিতা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকার আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি শীর্ষ নেতাসহ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালীরাও জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান, সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু, শেখ হাসিনার বান্ধবী সাবেক এমপি জোবেদা খাতুন পারুল প্রমুখ।

রাজশাহী রেঞ্জের এক জেলা পরিদর্শক (গোয়েন্দা) জানান, আসামিদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার বাড়ানো এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, শুরুর দিকে ব্যাপক গ্রেপ্তার হলেও এখন অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন বা দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়াদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে আসছেন, যা সরকারের উচ্চমহলের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উদ্যোগটি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মুখপাত্র) ইনামুল হক সাগর বলেন, কোনো মামলার পর আসামিদের খোঁজখবর নেওয়া ও তালিকা তৈরি করা পুলিশের নিয়মমাফিক কাজ। এটি তারই অংশ হিসেবে করা হয়ে থাকতে পারে।

ঢাকার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে প্রতিটি মামলার আসামিদের জামিনের শতভাগ বিরোধিতা করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়স, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন, তদবির, অসুস্থতা এবং দলীয় পরিচয়ের বিবেচনায় জামিনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অ্যাডভোকেট ফারুকী অভিযোগ করেন, অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তারা আসামিদের সঙ্গে সমঝোতা করে সাদামাটা প্রতিবেদন জমা দেন, যাতে জামিন পাওয়া সহজ হয়।

পুলিশের সদরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর ও সম্ভাব্য অনিয়মের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই সরকারের উচ্চমহল থেকে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর আসামিদের গ্রেপ্তার ও জামিনের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের এই তালিকা সেই কার্যক্রমেরই একটি অংশ।

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধবিষয়ক গবেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আসামিদের জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে দেখতে হবে, তাঁরা কোন ধরনের মামলায় জামিন পাচ্ছেন এবং কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিতে জামিন দেওয়া হচ্ছে কি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *