,

ইমরান, নওয়াজের পরিণতিটা ভাবুন!

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে সুস্পষ্ট ব্যবধানে জয়ী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তিনিই যে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, সেটা প্রায় নিশ্চিত। ইমরান নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বৃহস্পতিবার যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে ক্ষমতার মসনদে বসতে ‘তর সইছে না’ তাঁর। বক্তব্য দিলেন ‘প্রেসিডেন্ট-স্টাইলে’। কিন্তু ইমরান বোধ হয় নওয়াজ শরিফের পরিণতিটা কখনো ভাবেননি।

এই নির্বাচনে ইমরানের প্রতি সেনাবাহিনীর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিল। সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ইমরান ক্ষমতায় আসছেন, এমন গুঞ্জন চাউর হয়েছিল নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অনেক আগেই। কেউ কেউ ইমরানকে সেনাবাহিনীর ‘পালকপুত্র’ বলেও আখ্যা দেন। নির্বাচনে ইমরান ছাড়া বেশির ভাগ বড় দল কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক বিষয়াদির বিশ্লেষক আফ্রাসিয়ার খটক বলেছেন, এই নির্বাচন নিয়ে শুধু ইমরান ছাড়ার সব দলের অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও ইমরান অবশ্য তুড়ি মেরে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিষয় নয়। ৭১ বছর বয়সী দেশটিতে বেশির ভাগ সময় ছিল সামরিক বা উর্দি ছাড়া সামরিক একনায়কদের শাসন। বাকি সময়টা সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের হিসাব-নিকাশেই রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হতো। যখন প্রয়োজন হয়েছে তখন কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে মদদ দিয়ে তার নেতাকে ‘বিশুদ্ধ’ নেতার তকমা দিয়ে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। আবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে মনে করলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

এমন উদাহরণের জন্য পাকিস্তানের ইতিহাসের দূর অতীতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নির্বাচনের ময়দানে ইমরানের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লিগে–নওয়াজের (পিএমএল–এন) প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালেই চলে। লাহোরে ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া নওয়াজ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষে গত সত্তরের দশকে রাজনীতিতে পা রাখেন। ১৯৭৬ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান মুসলিম লিগে যোগ দেন। পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক তাঁকে পাঞ্জাব প্রদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর ১৯৮৫ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ। তবে বলা হয়ে থাকে, জেনারেল জিয়াউল হক মূলত নিজের প্রয়োজনে রাজনীতিক নওয়াজকে কাছে টেনে নেন। জেনারেল জিয়া ওই সময় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে ঠেকানোর জন্য রাজনৈতিক অস্ত্র খুঁজছিলেন। তখন জিয়ার সেই অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন নওয়াজ। যার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর খুব কাছের রাজনীতিক বনে যান তিনি। সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ আর নিজের ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ। তবে পরে অভিযোগ ওঠে, ওই নির্বাচনে নওয়াজকে জেতাতে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সরাসরি কাজ করেছে। শুধু তা–ই নয়, নওয়াজের নির্বাচনী প্রচারণায় লাখ লাখ রুপি খরচ করেছে এই গোয়েন্দা সংস্থাটি। নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তিন বছরের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হারান নওয়াজ। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সেনাবাহিনীই কলকাঠি নাড়ে বলে মনে করা হয়। ১৯৯৭ সালে নওয়াজ আবারও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে তাঁকে সরিয়ে দেন। আর সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশে পদত্যাগে বাধ্য হন নওয়াজ। এবার আদালতকে সামনে রেখে সেনাবাহিনী কলকাঠি নেড়েছে বলে মনে করা হয়। আর এখন তো ১০ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে আছেন তিন-তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ।

এখন প্রশ্ন হলো, শুরুর দিকে এত মদদ দিয়ে পরে সেনাবাহিনী কেন নওয়াজকে ছুড়ে ফেলছে? উত্তর: পরের দিকে সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত হয়ে ‘আসল রাজনীতিবিদ’ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নওয়াজ। নিজের প্রতিষ্ঠিত দলকে জনগণের দলে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিষয়টি পছন্দ করেনি সেনাবাহিনী। কারণ এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলকে দিয়ে সেনাবাহিনী কখনো নিজের অভিপ্রায় পূরণ করতে পারে না। এসবের ফল নওয়াজের আজকের পরিণতি।

রাজনীতিতে ইমরান খানের উত্থান ও ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আশির দশকে নওয়াজের রাজনৈতিক উত্থানের খুব মিল পাওয়া যায়। এবার নওয়াজকে শিক্ষা দিতেই নতুন অস্ত্র খুঁজছিল সেনাবাহিনী। সেই অস্ত্র হিসেবে তারা কাছে টেনেছে ইমরানকে। জনগণের কাছে ইমরানের গ্রহণযোগ্যতা আর প্রধানমন্ত্রী হতে তাঁর মরিয়া হয়ে ওঠা—এ দুই বিষয় মাথায় রেখে সেনাবাহিনী টেনে নেয় তাঁকে। এ ছাড়া নওয়াজের ভালো কোনো বিকল্প সেনাবাহিনীর হাতে ছিল না।

নির্বাচনের আগে দ্য ফ্রাইডে টাইমস–এ নিবন্ধ লিখেছেন পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক নাজাম শেঠি। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান অদ্ভুত এক সময় পার করছে। কিছু রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিককে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কিছু দল ও রাজনীতিককে মহান করে তুলে ধরার জন্য কূটকৌশল খাটানো হচ্ছে। অতীতেও এসব হয়েছে সামরিক আইন ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ছত্রচ্ছায়ায়। নাজাম শেঠি তাঁর লেখায় কারও নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এখানে ইমরান ও নওয়াজের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

যা–ই হোক, এখন মসনদে বসার অপেক্ষায় ইমরান। তবে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রী হতে হচ্ছে তাঁকে। সেনাবাহিনী তো এমনটাই চেয়েছিল! কারণ ঝুলন্ত পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রীকে ‘যেমন খুশি তেমন নাচাতে’ পারবে তারা। প্রয়োজন শেষ হলে ছুড়েও ফেলা যাবে! যেমন করা হয়েছে নওয়াজের সঙ্গে। ইমরান, নওয়াজের পরিণতিটা ভাবুন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *