,

খুলনার দাকোপে সুপেয় পানির সংকট : পানির লাইনের টেয়াপ ও খোলা পানি বিক্রির দোকানে দীর্ঘ লাইন

খুলনা প্রতিনিধিঃ– খুলনার দাকোপে শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই সুপেয় পানীয় জলের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির লাইনের টেয়াপ ও খোলা পানি বিক্রির দোকানেও পড়ছে দীর্ঘ লাইন। কিছু লোক আবার দুর দুরান্ত থেকেও সংগ্রহ করছেন এই পানি। বাধ্য হয়েও কেউ কেউ ডোবা-নালার পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ নানা পানি বাহিত রোগে ভুগছেন। সরেজমিন ঘুরে আজ ৩১ মার্চ রবিবার দেখা যায় কাটফাটা রোদ ও প্রচন্ড গরমের তীব্রতায় সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে অবহেলিত দাকোপের দুই লক্ষাধিক মানুষ। সকাল থেকে দুপুর, বিকাল থেকে সন্ধ্যা তবুও মিলছে না টেপের লাইনে পানির সন্ধান। এখন উপায় কি। তবুও হাল ছাড়ছে না যদি আসে পানি টেপে। সারাদিন কেটে গেছে তা কি হয়েছে যদি সন্ধ্যায় পানি আসে টেপে। এই দৃশ্যটি চোখে পড়ে বাজুয়া খুটাখালি বাজারের নৌকা হাটের পাশে নিরার দোকানের কাছে পানির লাইনের টেপের পাশে অধির আগ্রহে বসে আছে ৮০ বছরের এই বৃদ্ধা সাথে একটা মেয়েকে নিয়ে পানির আশায়। এছাড়াও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা এই উপজেলা ৩টি পৃথক দ্বীপের সমন্বয় গঠিত। এর চার পাশে নদীতে লবণ পানির প্রচন্ড চাপ থাকায় খরা মৌসুমে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেয়। প্রতি বছরের মত এবারও ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানীয় জলের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির জন্য হা-হুতাশ করছেন। এমনকি চায়ের দোকান, খাবার হোটেল, মিষ্টির দোকানে খরিদ্দারকে বিশুদ্ধ পানি দিতে না পেরে দোকানদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। আবার চলতি রবি মৌসুমে এ অঞ্চলের প্রধান ফসল তরমুজ, বোরো ক্ষেতেও সেচ দিতে না পারায় গাছ মরাসহ ফল ভালো বড় না হওয়ার কারণে অনেক কৃষক লোকসান খেয়েছেন। এখানে কোথাও গভীর নলকুপ সফল না হওয়ায় রয়েছে অগভীর নলকুপ যা অধিকাংশ অকেজো। আবার কোন কোন নলকুপের পানিতে লবণ, আর্সেনিকযুক্ত এবং অতিরিক্ত আয়রন।
এছাড়া এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত রেইন ওয়াটারও নেই। যে কারনে এলাকার মানুষের খাবার পানির একমাত্র ব্যবস্থা পুকুরের পানি ফিল্টার করে খাওয়া। কিন্তু অপ্রতুল পুকুরগুলোতে পানি স্বল্পতার কারণে প্রায় সকল ফিল্টার বা পিএসএফ গুলি অকেজো হয়ে পড়েছে। এলাকার কতিপয় স্বচ্ছল ব্যক্তিরা বটিয়াঘাটা, খুলনাসহ বাহিরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি কিনে জীবন ধারণ করছেন। আর মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম আয়ের মানুষ বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে যে পুকুরে পানি আছে সেখান থেকে সরাসরি পানি নিয়ে পান করছেন। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র অভাবের কারণে এই বৃহৎ জনগোষ্টিকে বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার অনুপযোগী পানি খেয়ে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই ডায়রিয়াসহ নানা পানি বাহিত রোগে ভুগছেন বলে জানা গেছে।
কালাবগি এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নিমাই মন্ডলসহ আরো অনেকে জানান, প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পথ নৌকায় যাওয়া আসা করে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন কৈলাশগঞ্জ এলাকা থেকে অতি কষ্টে বিশুদ্ধ পানি এনে খেতে হচ্ছে। আর যাদের ভাল অবস্থা টাকা পয়সা আছে তারা বাহিরে থেকে পানি কিনে খায়। আবার এলাকার কিছু অসহায় গরিব মানুষ সরাসরি পুকুরের অবিশুদ্ধ পানি পান করছেন বলে তিনি জানান।
চালনা বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী সমরেশ মন্ডল বলেন, পানি সংকটের কারণে খরিদ্দারদের পানি দিতে পারছি না। পুকুরের পানি খাবার অনুপযোগী হওয়ায় তা দিয়ে প্লেট ধোয়া পালার কাজ চলছে আর খরিদ্দাদের এক টাকারও বেশি দামে প্রতি লিটার পানি কিনে খেতে দিতে হচ্ছে। তার মত চা দোকানদার মিলন মল্লিকও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে চালনা পৌর সভার প্যানেল মেয়র মেহদী হাসান বুলবুল বলেন, সুপেয় পানি সংকট নিরসনে এ পৌরসভায় পানির প্রকল্পের আওতায় একটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টের কাজ শেষ হয়েছে। একই সাথে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনের কাজও বর্তমানে সেটি পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে আর এই কাজ সম্পন্ন হলেই পৌর এলাকায় সুপেয় পানি সংকট অনেকটা নিরসন হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ব্যাপারে উপজেলা উপ-সহকারি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, বর্তমানে এখানে সুপেয় পানির আধারের মধ্যে ২৬৬৮টি রেইন ওয়াটার হারভেটিং (ট্যাংকি), ২৭টি গভীর নলকূপ, ৫০০টি অগভীর নলকূপ সচল রয়েছে। এছাড়া সমগ্রদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের ২৩৪টি, উপকূলীয় জেলা সমুহে বৃষ্টির পানি সরবরাহ প্রকল্পের ৮৩৩টি ট্যাংকি, কমিউনিটি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ২১টি, ১৮টি পন্ড আল্টা ফিল্টার, আরও প্লান্ট ২টি ও ১৫টি ভ্যাসেল টাইপ পিএসএফের কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া কয়েকটি এনজিও কিছু পানির ট্যাংকি ও কয়েকটি পানি বিশুদ্ধ করণ প্যান্ট নির্মাণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় রয়েছে অপ্রতুল। এই উপজেলার অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানির জন্য রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মার্চ হতে মে মাস পর্যন্ত প্রচন্ড তাপদাহ এবং খরার কারণে পানির চাহিদা তীব্র থাকে। এ অঞ্চলে তরমুজ চাষের সময়ও ব্যাপক পানির সংকট দেখা দেয়। উক্ত সময়ের জন্য ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুকুর, দিঘি খনন করা প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন খাল খননের মাধ্যমে কৃষি জমিতে সেচ এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, পানি সংকট সমাধানের জন্য এ অঞ্চলে আরো অনেক বেশি রেইন ওয়টার হারভেটিং (ট্যাংকি) ও পুকুর খনন করা দরকার। একই সাথে পানির জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণও করতে হবে। এ ব্যাপারে দাকোপ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুনসুর আলী খান এর সাথে কথা হলে তিনি বললেন, এ উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সে কারণে উপজেলা পরিষদ থেকে হতদরিদ্র পরিবারের জন্য পানির ট্যাংকি বিতরণ করার জন্য একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি যে সকল এলাকায় মোজা পুকুর ও খাল আছে তা পযার্য়ক্রমে খননের জন্য কার্যকারী ব্যবস্হা গ্রহণ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *