,

চারুকলায় পুড়ে ছাই ফ্যাসিবাদের মোটিফ-আগুন দিয়েই দ্রুত সটকে পড়ে দুর্বৃত্ত

ঢাবি,প্রতিনিধিঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য় প্রধান মোটিফ হিসেবে বানানো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মুখাবয়বের প্রতিকৃতি পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি থাকা শান্তির পায়রা ও বাঘের মোটিফও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিসিটিভি ফুটেজে কালো টি-শার্ট পরা একজন দুর্বৃত্তকে দেখা গেছে আগুন দিতে। ওই দুর্বৃত্ত আগুন দিয়ে দুই মিনিটের মধ্যেই দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।

গতকাল শনিবার ভোর পৌনে ৫টা থেকে ৫টার মধ্যে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সোয়া ৫টা নাগাদ ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয়। স্বৈরাচারী হাসিনার প্রতিকৃতি দিয়ে বানানো দানবীয় মোটিফটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঘটনা তদন্তে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন- আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোসাদ্দেক হোসেন কামাল এবং সহকারী প্রক্টর ড. এ কে এম নূর আলম সিদ্দিকী। এ ছাড়া সহকারী প্রক্টর মো. ইসরাফিল প্রাং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ওই ঘটনা অনুসন্ধানের লক্ষ্যে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। শাহবাগ থানা এটি নিয়ে কাজ করছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কাউকে আটক করতে সক্ষম হয়নি।

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এম মো. নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা মোটিফটি পছন্দ করে না তারাই করেছে, এটা অনুমান করে বলা যায়।

এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জানান, ওই ঘটনার জড়িতদের চিহ্নিত করতে তারা কাজ করছেন।

যোগাযোগ করা হলে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেন, নববর্ষের শোভাযাত্রা উদযাপনের জন্য অনেকগুলো মোটিফের মধ্যে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রায়’ আগুনের ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে একজনকে শনাক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি। আগুন লাগানোর ঘটনা বর্ণনা করে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভোর ৪টা ৪৫ মিনিট থেকে ৪টা ৫০ মিনিটের মধ্যে একজন ব্যক্তি চারুকলার ছবিরহাট দিয়ে প্রবেশ করে মোটিফে আগুন দেয়। মোটিফগুলো যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে প্রবেশ করে প্রথমে লিকুইড দেয় তারপর আড়ালে এসে লাইটার জ্বালিয়ে ফায়ার টেস্ট করে। পরে মোটিফে আগুন দিয়ে ছবিরহাট দিয়েই বেরিয়ে যায়। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির পরনে কালো রঙের টি-শার্ট, ব্রাউন প্যান্ট ও পায়ে কালো রঙের স্যান্ডেল ছিল।

নববর্ষের শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন ও শেখ হাসিনার দানবীয় মুখাকৃতির মোটিফ বানানোর কথা উঠলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোটিফগুলো নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তারা।

চারুকলায় নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রক্টর বলেন, আমরা নিরাপত্তা ইস্যুতে সচেতন ছিলাম। ভোর ৪টা ৫০ মিনিট থেকে ৫টা পর্যন্ত এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে সময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা নামাজে গিয়েছিল। এ সময় সবাই একটু ক্লান্ত থাকে। সেই সুযোগকেই কাজে লাগানো হয়েছে। প্রক্টরিয়াল বডির একটি টিম ক্যাম্পাসে রাউন্ড দেয়- তারা চারুকলার ভেতরে আগুন দেখে এবং দ্রুত সেখানে যায়। পুলিশ সদস্যরাও সেসময় আসে।

চারুকলায় এখনো ফ্যাসিস্টের দোসররা রয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যেও এখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর রয়েছে- শিক্ষার্থীদের এমন মন্তব্যের বিষয়ে প্রক্টর আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের মন্তব্যকে একেবারে অমূলক বলার কোনো সুযোগ নেই। যারা এ বিষয়ে আশঙ্কা করছেন তারা তদন্ত কমিটির কাছে তাদের বক্তব্য জানাবেন। পাশাপাশি তথ্য-উপাত্ত থাকলে তদন্ত কমিটির কাছে জানানোর কথাও বলেন তিনি।

এদিকে গতকাল দুপুরে চারুকলায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি দু-এক মিনিট ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সেখান থেকে চলে যান। পুলিশ থাকতে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মুখ খোলেননি তিনি।

ফ্যাসিবাদী দানবীয় এই মোটিফটি নতুন করে তৈরি করা হবে কি না সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানান চারুকলা অনুষদের ডিন ও নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ। তিনি বলেন, আমরা অনুষ্ঠানের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখন শেষ মুহূর্তে এসে দু-এক দিনে এত বড় একটা কাজ করা সম্ভব নয়। তবে চারুকলার বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা মিলে এটা নিয়ে আলোচনা করছে। রোববার (আজ) এটা বোঝা যাবে।

কাজের অগ্রগতির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব সহকারী প্রক্টর মো. ইসরাফিল প্রাং বলেন, এখনো সিসিটিভি ফুটেজ বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখা হচ্ছে। অপরাধী শনাক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন।

এ বিষয়ে বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, মোটিফ তৈরির কাজটি মূলত চারুকলা আর শিল্পীরা মিলে করে থাকে। নতুন করে মোটিফ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা সেখানে থাকবে।

এদিকে চারুকলা অনুষদে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দানবীয় মুখাকৃতির মোটিফে আগুন লাগানোর ঘটনাটি রহস্যজনক নয় বরং এটি পরিকল্পিত বলে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। গতকাল সংগঠনটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদ হাসান খান, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার স্বাক্ষ‌রিত এক বিবৃতিতে এই মন্তব্য করেন তারা।

এ ছাড়া মোটিফে আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে অগ্নিকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায় শিক্ষকদের এই সংগঠন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *