,

রানার ভাবনা জুড়ে এএফসি কাপ – কিংসকে আরো উঁচুতে নিতে চান

ছবি: আলমগীর কবির রানা

স্পোর্টস ডেস্ক : প্রিমিয়ার লিগে এক দশকের বেশি সময় ধরে খেলছেন জাতীয় দল এবং সময়ের সেরা ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আলমগীর কবির রানা। সেই ২০০৯-১০ সালে মোহামেডানের জার্সিতে শুরু। এরপর একে একে দেশের আরো তিন শীর্ষ ক্লাব শেখ জামাল, ‍মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ রাসেলে কয়েক মৌসুম করে খেলেছেন। এতগুলো ক্লাবের জার্সিতে খেলার পরও তার সমস্ত মন, সত্তা জুড়ে কেবলই বসুন্ধরা কিংস।

গেল বছরের অক্টোবরে এএফসি কাপে মালদ্বীপের ক্লাব মাজিয়া স্পোর্টসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে মাঠে ফেরার কথা ছিল লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের। কিন্তু করোনার কারণে সেবার এএফসি কাপ হয়নি। চলতি মাসে এএফসি কাপ খেলার কথা রয়েছে। গেলবার এএফসি কাপ খেলতে না পারলেও কিংস তাদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট-লিগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ততা বেড়ে যায় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গর্ব আলমগীর রানারও। এর মধ্যে ক্লাবের হয়ে ফেডারেশন কাপ জেতেন রানারা। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম লেগ শীর্ষ থেকে শেষ করে।

প্রথমবারের মতো এএফসি কাপ খেলতে যাচ্ছে দেশের জনপ্রিয় ক্লাব বসুন্ধরা। তবে দলের অন্যতম সেরা অস্ত্র রানার এর আগেও এএফসি কাপে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। শেখ জামালের হয়ে ২০১৫-১৬ মৌসুমে এএফসি কাপে খেলেছেন এ ফুটবলার। সেই অভিজ্ঞতা কিংসেও কাজে লাগাতে চান। ঘরোয়া আসরগুলোতে যেমন দাপুটে পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে একের পর এক শিরোপা ঘরে তুলছে কিংস; এবার প্রিয় ক্লাবকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সাফল্যে রাঙাতে চান রানা।

কিংসের প্রতি অন্যরকম এক মায়ায় জড়িয়ে গেছেন আলমগীর রানা। ক্লাবটি প্রিমিয়ারে ওঠার জন্মলগ্ন থেকেই যে খেলছেন তিনি। বসুন্ধরা কিংস ক্লাব কর্তৃপক্ষের প্রতিও কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তার। ক্লাব সভাপতি ইমরুল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মিনহাজ থেকে শুরু করে ক্লাবের প্রতিটি সেক্টরে কাজ করা কর্তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ তার কথাতে। করোনাকালে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরে থাকলেও মন পড়ে আছে তার বসুন্ধরা কিংসের ওই সবুজ মাঠে, ক্লাব রুম আর সতীর্থদের আড্ডায়। সবাইকে বড্ড মিস করছেন।

ছবিঃ আলমগীর কবির রানা


আলমগীর রানার হৃদয়ের এক পাশে বসুন্ধরা কিংস; অপর পাশে তার ভালোলাগা-ভালোবাসার জায়গা প্রিয় শ্যামনগর ফুটবল একাডেমি। একজন রানিং পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পরও একাডেমির জন্য যা করে যাচ্ছেন রানা; সত্যিই তা বিরল। শ্যামনগর ফুটবল একাডেমির চেয়ারম্যান পদে থাকলেও তিনি একা সব কিছু করেন না। সাধারণ সম্পাদক রোকন এবং একাডেমি কোচ আক্তার তিনের সমন্বয়ে সব কিছু সম্পাদিত হয়। ২০১০ সাল থেকে একাডেমির কার্যক্রম শুরু। তবে ২০১২ সালে রানা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর একটা গতি এসেছে একাডেমিতে।

রানার একাডেমির শিক্ষার্থীরা বেশ মেধাবী। বর্তমানে একাডেমিতে ছেলে-মেয়ে ফুটবলার মিলে ৭০ জনের বিশাল দল। এই একাডেমি থেকে অনেক ফুটবলার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বি্কেএসপি), যশোর শামসুল-হুদা ফুটবল একাডেমিসহ ঢাকা মহানগরী লিগ কমিটির আওতাধীন পাইওনিয়ার থেকে প্রথম বিভাগে খেলছেন। জাতীয় বয়সভিত্তিক দলেরও অংশ হয়েছে। কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রখ্যাত সুব্রত কাপেও রানার একাডেমির ছাত্রের খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

কোনো ধরনের আর্থিক প্রণোদনা, অনুদান ছাড়া শুধু রানা আর রোকনের চেষ্টায় চলছে শ্যামনগর ফুটবল একাডেমি। এই একাডেমির সাফল্যের খবর সাতক্ষীরা ক্রীড়া সংস্থারও অজানা নয়। একাডেমি বিষয়ে ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে প্রায়শই আলোচনা হয় রানার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দেশের ১২১টি একাডেমিকে নিজেদের আওতায় নিয়ে সহযোগিতা করবে- এমন খবর জানতে বাফুফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আলমগীর রানা।

রানার অনুরোধ, তার একাডেমি থেকে যেহেতু ভালোমানের ফুটবলার প্রতি বছর বিভিন্ন জায়গাতে খেলার সুযোগ পাচ্ছে, সাফল্য পাচ্ছে সেহেতু শ্যামনগর একাডেমিকে বাফুফে যেন ১২১টি একাডেমির মধ্যে রাখে। একই সঙ্গে একাডেমিকে ফুটবলসহ অন্যান্য কিটস দিয়ে সহায়তারও অনুরোধ রেখেছেন। তাছাড়া বাফুফের প্রশিক্ষিত কোচ দিয়ে একাডেমির কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করারও অনুরোধ ছিল তার।

নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম সেরা এবং মেধাবী মিডফিল্ডার আলমগীর কবির রানা। মেধার জোরেই ২০০২ সালে বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। বাবার হাত ধরে সুদূর সাতক্ষীরা থেকে সাভারের বিকেএসপিতে আসা তার। বাবার কারণেই ফুটবলার হতে পারা। তবে ফুটবলে হাতেখড়ি শ্যামনগরের স্থানীয় কোচ আইজুল মোল্লার কাছে। রানার প্রিয় আইজুল কাকা। আইজুল মোল্লাই প্রথম রানার মধ্যে ফুটবলার হওয়ার গুণ, প্রতিভা দেখতে পান। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে রানাকে ফুটবলের পাঠ শেখান তার আইজুল কাকা।

২০১১ সালে বাবাকে হারান রানা। বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পরই ফুটবল থেকে অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি, যশ-খ্যাতি আসে রানার। প্রিয় বাবা ছেলের এমন সাফল্যকে চোখে দেখে যেতে পারেননি; সে কথা ভেবে এখনো চোখে জল আসে রানার। মা, তিন ভাই, এক বোন- রানাদের সংসার। রানার বড় ভাইও ফুটবল খেলতেন। তবে রানাই বংশের একমাত্র ছেলে যে কিনা জাতীয় দলের পাশাপাশি দেশের শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল খেলছেন।

২০০৯ সালে বাড্ডা জাগরণীর হয়ে প্রথম বিভাগে শুরু তার। এর আগে অবশ্য বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়ে গেছে। দেশ সেরা কোচ মারুফুল হকের অধীনে বাড্ডার জার্সিতে খেলেন। বাড্ডা জাগরণীর হয়ে ভালো খেলার সুবাদে মারুফই রানাকে নিয়ে আসেন মোহামেডানে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্লাবের পাশপাশি জাতীয় দলেও ছিল সেরা পছন্দ। লাল-সবুজ জার্সিতে ২০১১ এবং ২০১৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন। জাতীয় দলের রানার সবশেষ থাকা ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে।

এরপর আর জাতীয় দলে ডাক আসেনি। তবে আশা ছাড়েননি রানা। বয়স এবং ফর্ম-ফিটনেস যেহেতু অনুকূলে; সেহেতু আবারো জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেন আলমগীর কবির রানা। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশুনাটাও চালিয়ে গেছেন। ঢাকার গ্রীন ইউনির্ভাসিটি থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করেছেন।

করোনাকালে অনেক কাজ করেছেন আলমগীর রানা। এলাকার দুস্থ-অসহায় মানুষদের আর্থিক এবং খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছেন, করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে এলাকার একটি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের দুস্থ-অভাবী প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সহায়তা করেছেন। করোনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সহযোগিতা তো অব্যাহত রয়েছেই; সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে যারা সহায়-সম্বলহীন তাদেরকেও সাধ্যমতো সাহায্য করছেন।

সাতক্ষীরা জেলাকে খান বাহাদুর আহমদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, নিলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন, সিকান্দার আবু জাফর, ডা. এম আর খান, আবেদ খান, আফজাল হোসেন, ফাল্গুনী হামিদ, তারিক আনাম খানছাড়াও হালের তারকা ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমানরা নিজেদের কর্মে আলোকিত করেছেন। ফুটবলে তেমনি সাতক্ষীরাকে আলোকিত করেছেন আলোরদিশারী আলমগীর কবির রানা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *