,

শাজাহান খান জেলে-এনায়েত বিদেশে, দেশকে অশান্ত করার মিশনের নেতৃত্বে ওসমান আলী

ডেস্ক রিপোর্টঃহাসিনার আমলে পরিবহন সেক্টরে মাফিয়া ছিলেন তিনজন। এরা হলেন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এবং ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। এরা পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছেন। শাজাহান খান এখন জেলে, এনায়েত উল্লাহ বিদেশে, তবে দেশেই আছেন ওসমান আলী।

হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন ঠেকাতে এই তিনজন মিলে পরিবহন শ্রমিকদের মাঠে নামিয়েছে। ঢেলেছেন লুট করা কোটি কোটি টাকা। ঠিক তেমনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে দেশকে অশান্ত করার জন্য শাজাহান খানের বাহিনীকে দিয়ে অরাজকতার সৃষ্টি করছেন দেশেই থাকা ওসমান আলী। তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, ওসমান আলীই এখনো এনায়েতের এনা পরিবহনের আয়ের টাকা নিয়ে তাদের শ্রমিকদের দিয়ে বোমাবাজি ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। এমনকি ছাত্রলীগের ক্যাডারদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে।

পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া খন্দকার এনায়েত উল্লাহ চাঁদাবাজি করে তুলেছেন হাজার কোটি টাকা। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তার হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা। গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। সড়কের একচ্ছত্র এ সম্রাটের বিরুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এমন অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। ইতোমধ্যে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার অধিকাংশই তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাব বলে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এদিকে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। যদিও আদালতের সেই রায় রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি। এসব গাড়ি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়, মেয়ে চাশমে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে রয়েছে। স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এনা পরিবহন ও স্টারলাইন স্পেশাল লিমিটেডের নাম রয়েছে। জামাল-কামাল নামে দুই সহোদরের তত্ত্ববধানে এখনো চলছে এনা পরিবহন।

দুর্নীতি দমন কমিশন এনায়েত উল্লাহর নামে ৭০টি, স্ত্রী নার্গিস সামসাদের নামে ১০টি, মেয়ে চাশমে জাহান নিশির নামের তিনটি এবং এনা ট্রান্সপোর্ট নামের ১৫২টি পরিবহনসহ মোট ২৩৫টি বাসের মালিকানার দালিলিক প্রমাণ পেয়েছে। যেগুলো বিক্রি করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছিল বলেও দুদকের গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে দুদকের হাতে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য আসতে শুরু করে। আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত বর্তমানে দুদকের হাতে রয়েছে। ইতোমধ্যে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তিনি এখন পলাতক।

বর্তমানে পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন এনায়েত উল্লাহ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সময় দেশছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারো দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে সংসদে পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু তখন তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সূত্র মতে, সিঙ্গাপুরে বসে এনায়েত উল্লাহ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন ওসমান আলীর সাথে। এখন এনায়েতের টাকায় ওসমানই পরিবহন শ্রমিক ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের ব্যবহার করে দেশকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত এনায়েতের নির্দেশে ওসমান আলী হাসিনা-বিরোধী আন্দোলন দমাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এমনকি তিনি অস্ত্র কিনেও সরবরাহ করেছেন শ্রমিক ও আওয়ামী ক্যাডারদের হাতে। কিন্তু হাসিনা পালানোর পরে তিনি গা-ঢাকা দেন। গত এক বছর অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকলেও এখন হাসিনার বিরুদ্ধে রায়কে কেন্দ্র করে সরব হয়ে উঠেছেন সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত এনায়েত উল্লাহ ও দেশেই লুকিয়ে থাকা ওসমান আলী। তার নির্দেশেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। অথচ পুলিশ তাকে না খুঁজে সন্ত্রাসীদের খুঁজছে। পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা জানান, ওসমান আলী ঢাকায় আছেন। শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তাকে ধরতে পারলেই অগ্নিসন্ত্রাস অর্ধেক কমে যাবে। শ্রমিক নেতারা জানান, শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর বিরুদ্ধেও কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে। তিনি সংগঠনের নাম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এই টাকা আত্মসাত করেছেন। সম্প্রতি এক অভিযোগে ওসমান আলীকে অপসারণ ও তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে ঢাকার শ্রমিক সংগঠনগুলো। টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ প্রভাব বিস্তারের প্রতিবাদে সংগঠনের সভাপতি বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন বেশ কয়েকটি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগপত্রে সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত ও কোনো ধরনের বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা।

অভিযোগপত্রে শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে অর্থ আত্মসাৎ ও সংগঠন-বিরোধী কর্মকা- তুলে ধরা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস ও কোচ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন, মিরপুর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। এ ছাড়া ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতিও এতে স্বাক্ষর করেনে। অথচ রহস্যজনক কারণে ওসমান আলীর বিরুদ্ধে সেই অভিযোগের তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। ওসমান আলীকে গ্রেফতার করা তা দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কোনো তদন্তও হয়নি। একজন শ্রমিক নেতা বলেন, এনায়েতের টাকার পাশাপাশি এনা পরিহনের দুই শতাধিক বিলাসবহুল বাস চলছে ওসমানের তত্ত্বাবধানে। জামাল-কামাল নামে দুই সহোদর এখন এনা পরিবহন চালাচ্ছেন, যার নেপথ্যে রয়েছে ওসমান আলী। বর্তমানে সরকার-বিরোধী সব কর্মকা-ের টাকার জোগান যায় এনা পরিবহনের আয় থেকে। আদালতের আদেশের পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও এনা পরিবহনের বাস জব্দ করা হয়নি। এর নেপথ্যেও রয়েছেন শ্রমিক নেতা ওসমান আলী। আরেক শ্রমিক নেতা জানান, শুধু যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া নয়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে অগ্নিকা- ঘটানোর পরিকল্পনা করেছে ওসমান বাহিনী। গত তিন দিনে নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি গার্মেন্টসে আগুন দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের দিন ওসমান বাহিনী আরো বেশি টাকা নিয়ে নামবে বলে আশঙ্কা করেছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *