নিজস্ব প্রতিবেদক
অকালেই ঝরে গেলো দুই কলেজশিক্ষার্থীর প্রাণ। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে আরও কয়েকজন। আহত ১২ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। এসব ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া বাস। নেপথ্যে আনাড়ি চালক। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে গতকাল রোববার রাজধানী ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে। নিহতরা হলেন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিয়া খানম ওরফে মিম এবং একই কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম। এ ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে সর্বত্র। এদিকে কলেজশিক্ষার্থীদের হতাহতের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকটি বাস ভাঙচুর করে তাদের সহপাঠীরা। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ঘটনাস্থল বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন র্যাডিসন ব্লু হোটেল (বিপরীত পাশে) সংলগ্ন রাস্তা। অনতিদূরেই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ। ক্লাসশেষে র্যাডিশন হোটেলের সামনের ফুটপাতে পরিবহণের জন্য অপেক্ষা করছিলো ওই কলেজের কিছু শিক্ষার্থী। দুপুর ১২টার দিকে মিরপুর-উত্তরা রুটে চলাচলকারী জাবালে নূর পরিবহণ লিমিটেডের একটি যাত্রীবাহী বাস সেখানে থামে। কিছু যাত্রী ও শিক্ষার্থী বাসে ওঠা-নামা করে। এ সময় একই পরিবহণের অপর একটি বাস দাঁড়িয়ে থাকা বাসের বাম পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে প্রবেশ করায় এতে চাপা পড়েন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুই কলেজশিক্ষার্থী। আহত হন অন্তত ১৫ জন। স্থানীয় লোকজন আহতদের উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক সগির মিয়া জানান, ওই হাসপাতালে ১৪ জনকে আনা হয়েছিলো। এর মধ্যে দুইজন মারা গেছেন। আরও ১২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। তবে অন্যরা আশঙ্কামুক্ত। এদিকে দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষার্থীরা দ্রুত ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। সড়ক অবরোধ করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন বিমানবন্দর সড়কে যাতায়াতকারীরা। পরে পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাহান হক বলেন, বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে রাস্তা সচল করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে অবরোধ তোলা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা থেমে থেমে ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মিরপুর-উত্তরা রোডের জাবালে নূর পরিবহণের একটি বাস মিরপুর থেকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে আসছিলো। এ সময় ফ্লাইওভারের গোড়ার দিকে, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলো একদল শিক্ষার্থী। ফ্লাইওভার থেকে নেমেই বাসটি দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। ডিএমপির ট্রাফিক উত্তরের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার শচিন মৌলিক জানান, জাবালে নূর (ঢাকা মেট্রো ব-১১৯২৯৭) পরিবহণের বাসের ধাক্কায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ জনতা বাসটি ভাঙচুর করেছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রেডিসন হোটেলের সামনে থেকে বনানী উড়াল সেতু ও কালশি উড়াল সেতু এবং শেওরা পর্যন্ত শতাধিক বাস ভাঙচুর করে। এসময় শিক্ষার্থীরা রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর ক্যামেরাও ভাঙচুর করা হয়। এদিকে এ ঘটনার পর গতকাল বিকালে সচিবালয়ে নৌ-পরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় দুই স্কুলশিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি পেতেই হবে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি হবে। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, যে যতটুকু অপরাধ করবে সে সেভাবে শাস্তি পাবে। যে শাস্তি হবে সেই শাস্তি নিয়ে বিরোধিতার কোনো সুযোগ এখানে নেই। গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল আহাদ জানান, দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে বাসচালক ও তার সহকারীকে (হেলপার) পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিহত মীমের বাবার নাম জাহাঙ্গীর ফকির। তিনি নিজেও একজন গাড়িচালক। গ্রামের বাড়ি বরিশালে। সপরিবারে বসবাস করতেন মহাখালী দক্ষিণপাড়ার ভাড়া বাসায়। তার ২ মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে মিম ছিলো দ্বিতীয়। জাহাঙ্গীর ফকির দায়ী চালকের ফাঁসির দাবি করে বলেন, আমি একজন গাড়িচালক, একই সঙ্গে বাবাও। এভাবে যারা গাড়ি চালায় তাদর ফাঁসি হওয়া উচিত। যেসব মালিকরা এসব গাড়িচালক নিয়োগ দিয়েছে, সরকারের তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের একতা পরিবহণের চালক জাহাঙ্গীর ফকিরের গতকাল ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথাছিলো। হঠাৎ মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি আরও বলেন, যারা ঢাকায় গাড়ি চালায়, তারা অদক্ষ। এরা আগে সিএনজি অটোরিকশা চালাতো। গাড়ির মালিকরা লাইসেন্স ছাড়াই এদের চালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। অতি সম্প্রতি বাসে ঊঠতে গিয়ে আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পায়েলকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় খালের পানিতে। এটি ছিল হানিফ পরিবহণের বাসচালকদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। গতকাল বিমানবন্দর সড়কে ভিন্ন কায়দায় বাসচালক বাসচাপা দিয়ে মেধাবী ২ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা এবং ১৩ জন শিক্ষার্থীকে আহত করেছে। অনেকেরই দাবি দেশের মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এ ধরনের হত্যা প্রতিরোধের পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। মানুষ এ ধরনের বাসচালকদের হাত থেকে রেহাই চায়। এছাড়া দুর্ঘটনার নামে এ ধরনের হত্যাকা- রোধে নতুন আইন প্রণয়নও এখন সময়ের দাবি বলে সচেতনমহল থেকে দাবি উঠেছে।
Design & Developed BY- zahidit.com
Leave a Reply