,

কিটো ডায়েটের ভালো মন্দ : মোঃ আনিছুর রহমান

একটু বয়স বাড়লেই শরীরের অতিরিক্ত ওজন আমাদের জন্য উটকো ঝামেলার কারন হয়ে দাঁড়ায়। একজন স্থূলকায় ব্যক্তির ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নানা প্রকার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই তাদের জন্য ডাক্তারদেরও প্রথম পরামর্শ হয় শরীরের ওজন কমানো।

এখনকার ডায়েট ট্রেন্ডে সবচেয়ে আলোচিত কিটো ডায়েট। ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তে চিনির মাত্রা কমানোয় কার্যকর এ ডায়েট। এ জন্য ডায়াবেটিস রোগীরা ঝুঁকছেন এর দিকে। কিটো ডায়েট কী এবং ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

কেবল ওজন কমানোই কিটো ডায়েটের মূল উদ্দেশ্য নয়;

এ ডায়েট সবার জন্য নয় কিটোজেনিক ডায়েট স্বল্প সময়ে ওজন কমানোর জন্য বেশ কার্যকরী হলেও এটি দীর্ঘ সময় ধরে অনুসরণ করা উচিত নয়। অনেকদিন ধরে এই খাদ্যাভাস মেনে চললে কিডনিতে পাথর, রক্তে প্রোটিনের আধিক্য, শরীরে খনিজ উপাদান ও ভিটামিনের অভাব এবং যকৃতে চর্বি জমতে পারে। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী কিটো ডায়েটের কারণে ‘কিটো ফ্লু’ নামক এক বিশেষ রোগ হয়। যদিও এই ফ্লু বেশিদিন থাকে না, তবুও এর জন্য ডায়েটে পরিবর্তন আনা উচিত।

এই ডায়েট দীর্ঘদিন অনুসরণ করলে কিটো ফ্লু নামক এক অসুখ হয় ;

যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে ও ইনসুলিনের উপর নির্ভর করতে হয়, কিডনির রোগ রয়েছে, ইটিং ডিজঅর্ডার রয়েছে তাদের জন্যও কিটো ডায়েট উপযুক্ত নয়। তাই নিজ উদ্যোগে এ ডায়েট শুরু না করাই ভালো। এটি শুরুর আগে আগে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অথবা একজন ডায়েটিশিয়ানের সাথে আলাপ করা উচিত।

১৯১১ সালের মৃগী বা খিঁচুনি রোগের চিকিৎসার জন্য ভালো কোনো ওষুধ ছিল না। তখন চিকিৎসকেরা কিটো ডায়েট দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা করতেন। তখন রোগীদের না খাইয়ে রাখা হতো, এতে শরীরে কিটোনবডি গঠিত হতো। এতে এপিলেপসি কমে যেত।

১৯৩৪ সালে প্রথম এপিলেপসির ওষুধ ফেনাবারবিটাল আবিষ্কারের পর থেকে এর জনপ্রিয়তা কমে যেতে থাকে। এরপর আবার ১৯৯৪ সালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়েও এ রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন আবার কিটো ডায়েটের আবির্ভাব হয়। এ সময় দেখা গেল এই ডায়েটের ফলে রোগীর ওজন কমতে দেখা যাচ্ছে। তবে এখন সব দেশেই এই ডায়েটের সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেকে কিটো ডায়েটের দীর্ঘকালীন প্রভাব এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে না জেনে এটি অনুসরণ করছে। এতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হচ্ছে।

কিটো ডায়েটে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ফ্যাট ৭০ শতাংশ এবং প্রোটিন ২০ শতাংশ। কিন্তু একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েটে ফ্যাটের পরিমাণ ২০ শতাংশ আর ৭০ শতাংশ ফাইবার থাকতে হয়। কিটো ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে আনার ফলে শরীরের মেটাবলিজম কার্বোহাইড্রেট থেকে ফ্যাটের মেটাবলিজমে পরিণত হয়। এতে শরীরে একটি অ্যাসিড তৈরি হয়, যাকে কিটো অ্যাসিড বলে। এটি শরীরের বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ায় দীর্ঘকালীন বা স্বল্পকালীন প্রভাব ফেলে।

প্রায় চার রকমের কিটো ডায়েট আছে এবং প্রতিটির কার্যকারিতা ও ফলাফল নিয়ে হাজার হাজার মানুষের ওপর প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, যাঁরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং যাঁরা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন, তাঁদের ভেতর মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু যাঁরা ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন, তাঁরা অনেক সুস্থ জীবন যাপন করেছেন। কিটো ডায়েটের শুরুতে যে ওজন কমে, তা পুরোটাই গøাাইকোজেন ভেঙে যে পানি বের হয় তার ওজন। এ ছাড়া শরীরে যখন কিটো অ্যাসিড বেড়ে যায়, তখন সেটি রোধ করতে হাড় থেকে ফসফেট ক্ষয় হতে থাকে। গøাইকোজেন, পানি এবং হাড়ের ওজন কমে যাওয়ায় কিটো ডায়েটের প্রথম দিকে হঠাৎ অনেক ওজন কমে যায়।

অনেক ডায়াবেটিস রোগী নিজের ইচ্ছেমতো কিটো ডায়েট করে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের ভেতর অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, কিডনির বিকল বা কিডনিতে পাথর, শরীরের লবণের তারতম্য, যাকে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বলা হয়—এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেকে আবার শুনে বা কোথাও পড়েছেন যে কিটো ডায়েট করলে ডায়াবেটিস আর কোলেস্টেরলের ওষুধ খাওয়া লাগে না, তাঁরা হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে, তাঁদের ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে কিটোঅ্যাসিডিস নামের রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

১৯৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা কিটো ডায়েট করেছেন, তাঁদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে ৫০ শতাংশ, স্ট্রোকে ৫০ শতাংশ এবং ক্যানসারে ৩৫ শতাংশ মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ, এখানে সবার অনেক টাকা খরচ করার মতো ক্ষমতা নেই। তাই এ দেশে ডায়াবেটিস রোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে প্রতিরোধ। তবে এখানে দেখা যায়, মানুষ ডায়াবেটিস হয়ে যাওয়ার পর এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাঁটেন। প্রতিরোধ করার জন্য হাঁটলে ১০০ জনের ভেতর ৮৪ জনের এ রোগ হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।

আর কারও যদি ডায়াবেটিস হয়েও যায়, তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে হবে, যেখানে ভালো থাকতে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৩০ শতাংশ প্রোটিন ও ২০ শতাংশ ফ্যাট থাকতেই হবে। এ ছাড়া ধূমপান এড়াতে হবে এবং সঠিক মাত্রায় ঘুমাতে হবে। ৬ ঘণ্টা ঠিকমতো না ঘুমালে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, হার্ট, কিডনি, চোখ ভালো রাখা কঠিন হবে। আর সবকিছু করার পর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না এলে ওষুধের আশ্রয় নিতে হবে।

কিটো ডায়েটের প্রথম দিকে শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা কম দেখা গেলেও ২ থেকে ৪ সপ্তাহের ভেতর এই ডায়েটের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। একজন ডায়াবেটিস রোগী সুস্থতা কেবল দুই সপ্তাহের না হয়ে যাতে দীর্ঘকালীন হয় এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *