একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা কথিত মডেল ও অভিনেত্রীদের দিয়ে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করতেই এসবির ইন্সপেক্টর মামুনকে খুন করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইন্সপেক্টর মামুন খান খুনের ঘটনায় জড়িত সকলকেই গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মিজান শেখ, মেহেরুন্নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিন ওরফে আন্নাফি, সুরাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া ও ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা। জানা গেছে, নারী মডেল ও অভিনেত্রীদের মাধ্যমে মামুন খানকে চাকরিচ্যুত শৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য আতিকের নেতৃত্বে ফাঁদে ফেলা হয়। এরপর তাকে জিম্মি করে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এসময় মামুন নিজেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর পরিচয় দেয়। এরপর তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে তার লাশ গুম করতে গাজীপুর এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি বাঁশঝাড়ে লাশটি ফেলে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। গ্রেপ্তারকৃত আতিক এই হত্যাকা-ে প্রধান ভূমিকা রাখে। আর তাকে সহযোগিতা করে স্বপন ও মিজান নামে চাকরিচ্যুত অপর দুই সদস্য। আর অন্যারা নিহতের লাশ গুমের সহায়তা করে। পুলিশের বিশেষ শাখার ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান গত ৮ জুলাই সবুজবাগ এলাকার বাসা থেকে বনানীতে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে নিখোঁজ হন। পরদিন তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদি হয়ে সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম রহমত উল্যাহ নামে মামুনের এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলা রাইদিয়া এলাকার একটি নির্জন বাঁশঝাড় থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে রাজধানীর বনানী থানায় হত্যামামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় নিহত মামুন ইমরান খানের বন্ধু রহমত উল্ল্যাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো, আবদুল বাতেন ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানান। তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত রহমত ?উল্লাহ ইন্সপেক্টর মামুনের বন্ধু। রহমত উল্লাাহ পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘ প্রায় ৪ থেকে ৫ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তাদের। তারা দুইজনে বিভিন্ন নাটক ও সিরিয়ালে অভিনয় করতো। আটককৃত আফরিনের সাথে রহমত পূর্বে অভিনয় করেছে। আর ঘটনার দিন আফরিন কল করে রহমতকে তার বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায়। রহমত পার্টিতে একা না গিয়ে ইন্সপেক্টর মামুনকে সঙ্গে নিয়ে যায়। তারা পার্টি করতে বনানীর বাসায় গেলে তাদের বাসার দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে হঠাৎ করে স্বপন, দিদার, আতিক ও মিজান প্রবেশ করে। এরপর অনৈতিক কাজের অভিযোগে মামুন ও রহমতউল্লাহকে আটক করে মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে মামুন মারা যায়। মামুন মারা যাওয়ার পর তারা হতবিহ্বল হয়ে যায়। রহমতের হাত-পায়ের বাঁধ খুলে দেয়। পরে তারা মামুনের লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১০ জুলাই গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলা এলাকায় রাস্তার পাশে একটি জঙ্গলে মামুনের বস্তাবন্দি লাশ ফেলে পরিচয় গোপন করার জন্য লাশে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে চেহারা বিকৃত করে। গ্রেপ্তারকৃত রহমত গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে বলে জানান তিনি। রহমতের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বাড্ডা ও হাজারীবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।সূত্র জানায়, পুলিশের ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খানের বন্ধু রহমত উল্যাহ গ্রেপ্তার হওয়ার পরই হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা জানতে পারে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ। রহমত উল্ল্যার তথ্যের ভিত্তিতেই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। এরপর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া এবং লাশ গুমের সঙ্গে জড়িতদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়। আর রহমত উল্লাহ গ্রেপ্তারের সংবাদ জেনে মামলার আসামিরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার পরপরই প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া রহমত উল্যাহর সূত্র ধরে প্রথমে যার জন্মদিনের কথা বলে মামুনকে বনানীর ২/৩ সড়কের ৫ নম্বর ভবনের এ-২ ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কথিত সেই মডেল মেহেরুন্নেসা ওরফে শেখ আন্নাফি ওরফে আন্নাফি আফরিনকে নজরদারির আওতায় আনা হয়। এরপর ওই বাসায় দেহব্যবসা ও অশ্লীল ছবি তুলে প্রতারণার ফাঁদ বসিয়েছিল সেই শেখ হৃদয় এবং তার স্ত্রী কথিত মডেল ও অভিনেত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়াকে আটক করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিজান, আতিক, রবিউল, ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সূত্রটি আরও জানায়, বনানীর ওই বাসাটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আদায়ের জন্য। এজন্যই সেখানে কোনো ফার্নিচার ছিল না। চক্রটি সাধারণত কয়েক মাস ব্যবহারের পর অন্য কোনো এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে একই ধরনের অপরাধ করে আসছিল। শেখ হৃদয় ছিলো ওই গ্রুপের প্রধান। আর নজরুল ইসলাম ওরফে নজরুল ওরফে রাজ নামে একব্যক্তি নিজের নামে বাসা ভাড়া নিয়ে শেখ হৃদয়কে দিয়ে এসব কাজ করাতো। হৃদয় তার স্ত্রী কথিত মডেল ও অভিনেত্রী কেয়া, আন্নাফি আফরিন ও আফরিনের বোন মাইশা ওরফে মিমকে ব্যবহার করতো টোপ হিসেবে। আর বাসাটির সার্বক্ষণিক কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োজিত ছিলো দিদার। এছাড়া, একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক তিন সদস্য আতিক, মিজান ও স্বপন নিয়মিত ওই বাসায় যাতায়াত করতো এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়ের কাজটি করতো। প্রতারণার মাধ্যমে আয়কৃত অর্থেল এক ভাগ শেখ হৃদয়কে আর অপর ভাগ তিনজন ভাগ করে নিত। হৃদয়ের ভাগের অংশ থেকে দেওয়া হতো কথিত তিন নারী মডেল ও অভিনেত্রীকে। এর আগেও সেখানে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে অশ্লীল ছবি তুলে অর্থ আদায় করেছিল বলে আটকরা স্বীকার করেছে।উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই রাজধানীর সবুজবাগ থানায় মামুনের নিখোঁজসংক্রান্তে একটি জিডি করা হয়। উক্ত জিডির ছায়াতদন্তকালে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিম মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের লাশ উদ্ধার ও ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়।
Design & Developed BY- zahidit.com
Leave a Reply