,

বেইলি রোডে আগুনে নিহত ৪৬ সিঁড়িই মৃত্যুকূপ

নিজিস্ব প্রতিনিধিঃ নির্মম। মর্মান্তিক। হৃদয় বিদারক। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানী, সিদ্দিকবাজারের পর বেইলি রোড। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার আর আর্তনাদ দিয়ে নিমিষেই ৪৬টি তাজা প্রাণ চলে গেল না ফেরার দেশে। নিহতদের কেউ কেউ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন আর বাকিরা অক্সিজেনের অভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বেইলি রোডের গ্রীন কোজি কটেজ সাততলা ভবনে রাত পৌনে ১০টার দিকে লাগা অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের লম্বা সারির খবর শুনে পুরো দেশ শোকাহত। মর্মস্পর্শী এই অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের ৫ জনসহ, মা-মেয়ে, সাংবাদিক, এডভোকেট, প্রকৌশলী, পুলিশ কন্যা, শিক্ষার্থীসহ অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটিতে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বেশি হওয়াতে বেশির ভাগ নিহতরা খাবার খেতেই সেখানে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া ভবনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন অনেকেই।

তারাও প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকা না হয়েও এবং এক ভবনের সঙ্গে আরেক ভবনের কিছুটা দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কেন নিহতদের লম্বা সারি? এই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। প্রশ্ন উঠেছে ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা নিয়েও। তাদের কি আটকে পড়াদের উদ্ধারের সক্ষমতা ছিল না?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে ভবনে আগুন লেগেছে ওই ভবনটিতে ছোট ছোট দু’টি লিফট আছে। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই লিফট অকার্যকর হয়ে যায়। এর বাইরে ভবনটিতে ওঠা-নামার জন্য একটি সিঁড়ি ছিল। তবে সিঁড়িটি খুবই সরু। একসঙ্গে একজনই উঠতে ও নামতে পারে। এর বেশি হলে একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে চলাচল করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া সিঁড়ির গোড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল। সিঁড়ির কিছু অংশে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখায় চলাচলের উপায় ছিল না। নিচতলায় আগুন লাগার পর নিমিষেই সেই আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। লিফট অকার্যকর হওয়াতে অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু সিঁড়ির গোড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। তাই ঝুঁকি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামার চেষ্টা করেননি। ভবনের বিভিন্ন তলায় আটকে পড়াদের অনেকেই ছাদে অবস্থান নেন। তাদের অনেককেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করেন। আর আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই বিভিন্ন তলায় যার যার অবস্থানে আটকা পড়েন। কিছু কিছু তলায় ভেন্টিলেশন ছিল না। তাই আগুন ছড়িয়ে পড়লে এসব তলায় আটকে পড়ারা ধোঁয়ার মধ্য পড়ে যান। তাই কার্বন মনোঅক্সাইডের কারণে নিঃশ্বাস নিতে না পারায় তাদের মৃত্যু হয়।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকের মৃত্যুর কারণ তারা পরীক্ষা করেছেন। অনেকেরই শরীরে বার্ন বা ক্ষত ছিল না। বেশির ভাগের এক্সটার্নাল বার্ন কম ছিল। আর যে পরিমাণ বার্ন ছিল তাতে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। মূলত অনেকের মৃত্যুর কারণ ছিল কার্বন মনোঅক্সাইডের বিষক্রিয়া। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, আমাদের হাসপাতালে ১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এরমধ্যে একজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রতে (আইসিইউ) ভর্তি। বাকিরা পোস্ট অপারেটিভ সেন্টারে রয়েছেন। তাদের এক্সটার্নাল বার্ন মারাত্মক নয়। তবে সকলের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে এবং ইন্টার্নাল বার্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে কার্বন মনোঅক্সাইড ইনফেল করেছেন। এটি মারাত্মক বিষাক্ত। এটি ইন্টার্নাল অর্গানগুলোকে নষ্ট করে দেয়। অক্সিজেন গ্রহণে বাধা প্রদান করে। ফলে যতক্ষণ না এই গ্যাস বের হচ্ছে রোগীরা শঙ্কামুক্ত নয়। যে কারণে আমরা স্পটে যাদের মৃত পেয়েছি তাদের এক্সটার্নাল বার্ন খুব বেশি ছিল না। তিনি বলেন, আমাদের যে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয় তাতে হাইড্রো কার্বন থাকে। এ ছাড়া মিথেন গ্যাস পুড়ে কার্বন মনোঅক্সাইড ও ডাই অক্সাইড তৈরি হয়। হাইড্রো কার্বন থেকে ডাই ও মনোঅক্সাইড তৈরি হয়। এটি মারাত্মক বিষাক্ত, এমনকি তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।

ভবনটিতে যা দেখা গেল: সরজমিন পরিদর্শন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাততলা গ্রীন কোজি কটেজ নামের ওই ভবনটির অধিকাংশ দোকানই খাবারের দোকান। এর বাইরে একটি অভিজাত কাপড়ের ব্র্যান্ড ইলিয়ানের ১টি শো-রুম, ১টি স্যামসাংয়ের শো-রুম, গ্যাজট অ্যান্ড গিয়ার নামে আরেকটি মোবাইল এক্সোসরিজের শো-রুম সেখানে ছিল। এরমধ্যে নিচতলার একেবারে সামনে ছিল স্যামসাং মোবাইলের শো-রুম। তার পরেই ছিল চায়ের চুমুক নামের একটি দোকান। এই দোকান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এ ছাড়া এই তলায় গ্যাজট অ্যান্ড গিয়ারের শো-রুম, শেখলিক জুস বার ও ওয়াফে বে নামের প্রতিষ্ঠান ছিল। দ্বিতীয় তলার পুরোটাই কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট, তৃতীয়তলায় ইলিয়ানের শো-রুম, চতুর্থতলায় খানাস নামের খাবারের দোকান, পঞ্চমতলায় পিৎজ্জা ইন, ষষ্ঠতলায় স্টিট ওবেন ও জেস্টি নামের দু’টি খাবারের দোকান, সপ্তমতলায় ফোকুস ও হাক্কা ডাকা এবং ভবনটির ছাদে অ্যামব্রোশিয়া নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এই ভবনটির উপরে ওঠা-নামার জন্য ছোট ছোট দু’টি লিফট ছিল। দু’টি লিফটের ধারণ ক্ষমতা খুবই কম ছিল। এ ছাড়া ছোট সরু সিঁড়ি থাকলেও সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওঠা-নামা করতো না। এ ছাড়া সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডারসহ অনেক কিছু দোকান মালিকরা রেখে দিতেন। মূলত লিফট নির্ভর ছিল ভবনটি।

দেখা যায়, ভবনের নিচতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রেস্তরাঁগুলোর চেয়ার টেবিল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে আছে এসির বিভিন্ন অংশ। এ ছাড়া লাইট, ফ্যান, রেস্তরাঁয় ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রও পুড়ে গেছে। ভবনের বিভিন্ন অংশের গ্লাসের টুকরো পড়ে আছে বিভিন্ন স্থানে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার কারণে পুরো ভবনটি ভুতুড়ে হয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিস, পিবিআই, সিআইডি, পুলিশ, র‌্যাব, কাউন্টার টেরোরিজমসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা আলামত সংগ্রহ, আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত করছেন। একটু পর পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসছেন বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ভবনের সামনে ক্রাইম সিন দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া তারকাঁটা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন: প্রত্যক্ষদর্শীরা মানবজমিনকে বলেন, গ্রীন কোজি কটেজ নামের এই ভবনটি বেইলি রোডের সবচেয়ে পরিচিত ভবন। কারণ এই ভবনেই সবচেয়ে বেশি খাবারের দোকান। তাই ভোজনপ্রেমীদের কাছে এটি অনেক পরিচিত। ঘটনার দিন ভবনের দ্বিতীয়তলায় কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে ৫০ শতাংশ ছাড় থাকায় ক্রেতাদের উপস্থিতি ভালো ছিল। নিচতলার মাস দেড়েক আগে যাত্রা শুরু করা চায়ের চুমুক নামের প্রতিষ্ঠান থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি চা-কফি, বার্গার বিক্রি করে। সৈকত নামের এক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাসা সিদ্ধেশ^রীতে। ছোট থেকে বড় হয়েছি বেইলি রোডে চলাফেলা করে। এখানকার কোন ভবনে কি আছে সবই আমাদের জানা। যে ভবনে আগুন লেগে এত মানুষ মারা গেল সেই ভবনে লিফট ছাড়া ওঠা-নামার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। সরু সিঁড়ি দিয়ে কখনোই কাউকে ওঠা-নামা করতে দেখিনি। কারণ একদিকে সরু আবার প্রায় সময়ই সিঁড়িতে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা হতো। তাই ওদিকে কেউ যাওয়া আসা করতো না। অনেক বছর ধরে আমরা ওই ভবনে যাই কিন্তু কখনো সিঁড়ি ব্যবহার করিনি।

তিনি বলেন, ঘটনার সময় ওই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পাই নিচতলার চায়ের চুমুক নামের ওই দোকানে আগুন জ্বলছে। পথচারী ও ভবনের নিচতলার অনেকেই আগুন আগুন বলে দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকার করছিলেন। কয়েকজন লোক আশপাশের ভবন থেকে ফায়ার এক্সটিংগুইসার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ততক্ষণে বিকট শব্দে আগুনের তীব্রতা বেড়ে উপরের দিকে চলে যায়। উপরের মানুষগুলো বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। অনেকে ভয়ে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। ভবনের বিভিন্ন দিক দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে অনেকে আহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস যতক্ষণে এসে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ততক্ষণে ভবনের বিভিন্ন তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

দুলাল হোসেন নামে প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, প্রথমে এসে দেখি চায়ের চুমুক নামের ওই প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগেছে। তখন রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা ও একজন পুলিশ সদস্য আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কোনোভাবেই আগুন নেভাতে পারেনি। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, স্ত্রীসহ খেতে এসেছিলাম ভবনটিতে। তখন দেখলাম সিঁড়ির গোড়ায় আগুন জ্বলছে। আমি স্ত্রীকে রেখে আরও কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে। তখন দেখি প্রতিটা তলায় থাকা লোকজন সামনের দিকে এসে দাঁড়িয়ে আছেন এবং বাঁচানোর আকুতি করছেন। আমরা কয়েকজন তাদের আশ্বস্ত করলাম। তার কয়েক মিনিট পরে কাঠের মই এনে দোতলায় লাগিয়ে বললাম বাচ্চাদের আগে দেন। পরে আমরা একটা জানালা দিয়ে কয়েকজন বাচ্চাকে নামালাম। বড়রা তেমন নামতে সক্ষম হননি। কয়েক মিনিট পরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এর ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড পরে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। আমার কাছে মনে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কয়েক মিনিট আগে আসলে অনেককে বাঁচানো যেত। তিনি বলেন, ভবনের সিঁড়িটি খুব সরু ছিল। কিন্তু ঘটনার সময় একটা লোকও সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেনি। কারণ সিঁড়ির গোড়ায় আগুন ছিল। সেখানে ১০ মিনিট ধরে আগুন জ্বলছিল।

ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্ত: প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে ভবনটিতে কোনো ধরনের অগ্নি নিরাপত্তা ছিল না। এ ছাড়া ভবনটিতে দুইটি ছোট লিফট ছিল এবং একটি সরু সিঁড়ি ছিল। অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এবং লোকজন বের হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এত প্রাণহানি ঘটেছে। সিঁড়ি সরু থাকার কারণেও নিহতরা বের হতে পারেননি। সিঁড়ি ও ভবনের সামনে রাখা গ্যাস সিলিন্ডারগুলোই প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ সিঁড়িকে মৃত্যুকূপে পরিণত করে। সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়িটি ‘অগ্নিচুল্লির’ মতো হয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেনি। যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগ আগুনে পুড়ে নয়, বরং ধোঁয়ার কারণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর আগে তারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আমরা ভবনের ৪টি ফ্লোর থেকে মরদেহ উদ্ধার করেছি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমতলা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে সব থেকে বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয় দ্বিতীয়তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে থেকে। কমপক্ষে ১৫ জনের মতো মরদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কারণ কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনার সময় সেখানে মানুষের উপস্থিতও ছিল বেশি। ভেন্টিলেশন না থাকায় প্রচণ্ড ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তারা মারা যান।

ভবনে রেস্তরাঁর অনুমতি ছিল না: গ্রীন কোজি কটেজে বাণিজ্যিক অনুমোদন ছিল তবে সেটিতে রেস্তরাঁ করার অনুমতি ছিল না বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেইলি রোডের ওই ভবনটির অনুমোদন আছে আটতলার। শুধু আটতলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন আছে। ভবনটির ১ থেকে ৭ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তরাঁ, শো-রুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়নি।

সুরক্ষা সচিবের বক্তব্য: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে অনেকে মারা গিয়েছেন। এই মৃত্যু কাম্য নয়। এই মৃত্যু কখনো মেনে নেয়া যায় না। এই ভবনটাতে একটা মাত্র সিঁড়ি আছে। ধোঁয়ার কারণে মানুষ যেখানে অচেতন হয়ে পড়েছিল। সেখানে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ছিলো না। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি, আমরা আসলে দেখতে চাই কারও কোনো গাফিলতি ছিল কিনা। ফায়ার সেইফটিসহ ভবন নির্মাণ করতে অন্যান্য সংস্থার অনুমতি ছিল কিনা তাও আমরা তদন্ত করে দেখবো। আমরা তদন্তে দেখতে পাবো কীভাবে আগুন লেগেছে এবং এখানে কারও কোনো গাফিলতি ছিল কিনা। তিনি বলেন, এই ভবনটাকে আগেই ফায়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি নোটিশ দেয়া হয়েছিলো। আমরা মনে করি যারা ব্যবসা করেন তাদের সকলকে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। আগুনের সূত্রপাত নিচতলা এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে হয়েছে বলে তিনি জানান।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করতে চায় র‌্যাব: অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করতে চায় র‌্যাব। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র‌্যাব ফোর্সেসের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেছেন, তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে ঘটনার কারণ কি। নিহতরা অক্সিজেনের অভাবে বা সাপোকেশনে মারা গেছেন। আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কম। সরকার যদি চায় এখানে র‌্যাবকে তদন্তের ক্ষেত্রে প্রয়োজন তবে আমরা তদন্ত করবো। আমাদের ইন্টেলিজেন্স উইং ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, সরকার যদি বলে যে, এখানে তদন্ত করা প্রয়োজন, সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক করা হয়েছিল কিনা তাহলে আমার সেটা তদন্ত করে দেখবো। কি উদ্দেশ্যে ভবনটি করা হয়েছিল, আর কি কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। খতিয়ে দেখলে বের হবে। তিনি বলেন, এখানে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি এখানে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটেছিল বলে আপাতত ধারণা করা হচ্ছে। আগুন যখন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল তখন তারা ফায়ার এক্সটিংগুইসার দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আরও বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ওপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আমাদের যদি মনে হয় এখানে ইনভেস্টিগেশন করা প্রয়োজন তাহলে আমরা সেটা করবো। আমাদের ইন্টেলিজেন্স উইং এ ব্যাপারে কাজ করছে। তারা তথ্য সংগ্রহ করছে।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান মানবজমিনকে বলেন, ভবনটিতে ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ২/৩ টা ইক্সটিংগুইসার ছিল। যেগুলো কোনো কাজেই আসেনি। বহির্গমন পথও ছিল না। যে পথ দিয়ে আটকে পড়ারা বের হতে পারতো। এ ছাড়া ওই ভবনের সিঁড়িও ব্যবহারযোগ্য ছিল না। তিনি বলেন, এক সময় কাঠের জিনিসপত্র দিয়ে রেস্টুরেন্ট সাজানো হতো। এখন ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়। এগুলোতে আগুন লাগলে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এগুলো মানুষ বেশি সময় সহ্য করতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। বেইলি রোডের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই ভবন করার সময় অবশ্যই ফায়ার সেফটির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *