,

আলোর ফেরিওয়ালা – পৌলোমী চক্রবর্তী  

কবি: পৌলোমী চক্রবর্তী  

আলোর ফেরিওয়ালা

পৌলোমী চক্রবর্তী  

 

মেয়েটি অন্ধকার রাস্তার কোণে বসে আলোর ফেরি করে….

বাংলা জুড়ে উৎসব… আলোকমালায় সজ্জিত প্রতিটি মন্ডপের দ্বার, আনন্দময়ীর আগমনে আলোর বেণু বেজে উঠেছে সবার মনে….

মেয়েটি অন্ধকার রাস্তার কোণে ছেঁড়া মাদুর পেতে বসে আলোর বেলুন হাতে হাঁকে,”নিয়ে যাও, ও খুকি, শুধু দশ টাকা…”

অন্ধকার রাস্তায় আলোর মালা দেখে কেউ কেউ ফিরে তাকায় একঝলক, কখনও বা ছোট কোন ছেলে মায়ের আঁচল টেনে বায়না ধরে, “ও মা, দাও না..” মা ভুরু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে নিজের দামী শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বলেন, “না না, এসব ফুটপাথের জিনিস আবার কেউ নেয় নাকি! ভালো দোকান থেকে কিনে দেব।” মেয়েটি প্রাণপণে হাঁকে,”ও দিদি, নিয়ে যান দিদি ভালো জিনিস আছে….ও দিদি….”

স্মুদনিং করা চুল কায়দা করে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে বৌটি এগিয়ে যান ছেলের হাত ধরে। সুখী পরিবারটি হেলেদুলে ঠাকুর দেখতে চলে গেলে মেয়েটি রাগে ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে বৌটির উদ্দেশ্যে অশ্রাব‍্য গালাগালি দেয়।

রাস্তা চলতি কোন মাতাল সেই গালাগালি শুনে এগিয়ে আসে….মেয়েটির পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার চেষ্টা করে তার মুখে একমুখ বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলে ওঠে, “ক‍্যায়া রে, চলতি হ‍্যায় ক‍‍্যায়া?” অন্ধকারে বসা মেয়েটির চোখে জ্বলে আগুনের ফুলকি, পায়ের চপ্পল খুলে হাতে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, “হারামি শালা! ভাগ ইয়াহাঁ সে। নহি তো ম‍্যায় চিল্লাউংগি!” লোক জমে যাবার ভয়ে মাতালটি উঠে পড়ে, টলমল পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,”ধন্দেওয়ালি শালি!” মেয়েটি অপরিসীম ক্ষোভে ও রাগে ফেটে পড়তে পড়তে চিৎকার করে ওঠে, “ম‍্যায় ধন্দেওয়ালি নহি! অন্ধেরে মে ব‍্যাঠ কর চিজেঁ বেচনেওয়ালি হর লড়কি অপনি জিসম নহি বেচতি।” চিৎকারের শেষটা আর্তনাদের মতো শোনায়।

আমরা দুর্গাঠাকুর দেখতে যাই, এই জ‍্যান্ত দুর্গা যারা প্রতিদিন দারিদ্র, ক্ষুধা, অভাব,অসভ‍্যতা ও অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের আমরা দেখেও দেখিনা। তাদের আমরা চিনতে পারিনা। আমরা ঝলমলে পোষাকে চকমকে আলোতে ঠাকুর দেখি, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় খাই, আর প্রেম করি। কিন্তু এই আলোয় ঢাকা অন্ধকার আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় বারবার।

এরই মধ‍্যে মেয়েটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এসছে, কয়েকটি ছোট শিশুর দল এগিয়ে এসছে…তাদের হাতে হাতে বিক্রি হয়ে গেল পাঁচ ছ’টা আলোর বেলুন। এবার মেয়েটির মুখে হাসি ফোটে। সে আজ পায়ে না হেঁটে টোটো নেয়। দশ টাকা খরচ হবে, তাতে কী! বাড়ি গিয়ে সে তার অনাথ ছোটবোনকে দেখাবে আজ সর্বমোট একশো টাকা রোজগার হয়েছে..কাল নবমী, পুজোর শেষ রাত। কাল আর অন্ধকার নয়, কাল আলো গায়ে মেখে তারা দু’বোন ও দুর্গা দেখতে বেরুবে। আর মন্ডপে বেজে উঠবে, “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *